‘সলপের ঘোল’: শত বছরেও স্বাদ অটুট

অদিত্য রাসেল, সিরাজগঞ্জ: স্থানীয় খামারিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা দুধ নির্দিষ্ট সময় জ্বাল দিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় সুস্বাদু একটি পানীয়। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সলপ রেলস্টেশন এলাকায় তৈরি এই পানীয়টি খ্যাতি পেয়েছে ‘সলপের ঘোল’ হিসেবে।

পানীয় হিসেবে বাঙালিদের কাছে ঘোল ও মাঠার এখনও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সিরাজগঞ্জ ছাড়াও ‘সলপের ঘোলের’ স্বাদ নিচ্ছেন দেশের নানা জায়গার মানুষ। এই পানীয় বিক্রি করে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জীবন-জীবিকা চালিয়ে যাচ্ছেন।

জানা যায়, প্রতিদিন ভোরে গ্রামের খামারিদের কাছ থেকে গরুর দুধ সংগ্রহ করে ঘোল ব্যবসায়ীরা। পরে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা জ্বাল দেয়া শেষে সারা রাত রেখে দেয়া হয়। পরে জমে থাকা দুধের সঙ্গে চিনি ও অন্য উপকরণ মিশিয়ে তৈরি করে এ সুস্বাদু ঘোল। সকালে প্লাস্টিকের বোতল, বড় ক্যান ও প্লাস্টিকের ড্রামে ক্রেতাদের হাতে হাতে চলে যাচ্ছে সিরাজগঞ্জের সলপের ঐতিহ্যবাহী ঘোল। রমজানের শুরু থেকেই এই ঘোলের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। রমজান শুরুতে ব্যস্ততার চিত্র দেখা যায় উল্লাপাড়ার সলপে। এক শত বছর ধরে বংশানুক্রমে ঘোলের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সুস্বাদু সলপের ঘোল যাচ্ছে সারাদেশে।

রমজান উপলক্ষে জেলার উল্লাপাড়ার সলপ স্টেশন থেকে প্রতিদিন ঘোল বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ মণ। প্রতি লিটার ঘোল ৭০ থেকে ৮০ টাকা এবং মাঠা বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা। এই সুস্বাদু পানীয় ঘোল জেলার ৯টি উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে সারাদেশেও। শুধু চলনবিল ও যমুনা নদীবেষ্টিত এই জনপদে নয়, দূরদূরান্তে ছড়িয়ে আছে সলপের ঘোলের সুনাম।

স্থানীয় লোকজন বলেন, এ ঘোল তৈরির পেছনে আছে ১০০ বছরের ঐতিহ্য। রমজানের সঙ্গে গরম পড়েছে। তাই এই ঘোলের চাহিদা বাড়ায় দিনরাত কাজ করে চলেছেন কর্মীরা। বিভিন্ন এলাকার পাইকারি ও খুচরা ক্রেতারা এই ঘোল কিনতে ভিড় করছেন।

গতকাল রোববার সকালে সলপ রেলস্টেশন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, স্টেশনের পাশে ঘোলের দোকানগুলো জমে উঠেছে। দোকানের সামনে মাটির পাত্রে পসরা সাজিয়ে চলছে বিক্রি। দোকানের পেছনে কর্মীরা ঘোল তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। দোকানের সামনে স্টিলের হাঁড়ি থেকে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ঘোল ও মাঠা বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। সেই সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলার পাইকাররা এখান থেকে ঘোল নিয়ে বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করেন। অনেকে আবার পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনদের জন্য ঘোল ও মাঠা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।  বিক্রেতারা বলছেন, প্রতিদিন এই এলাকায় ৩০ থেকে ৩৫ মণ ঘোল ও মাঠা বিক্রি হয়। বর্তমানে প্রতি লিটার ঘোল ৭০-৮০ টাকা, মাঠা ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সলপের ঘোলের সুনাম শুনে পাবনার বেড়া উপজেলা থেকে বন্ধুদের নিয়ে সলপে এসেছেন আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, সলপের ঘোলের একটা সুনাম আছে। গরমে ঘোলের স্বাদ নিয়ে একটু প্রশান্তির জন্য তারা সলপে এসেছেন। এই ঘোল আসলেই অনেক সুস্বাদু। আমরা পরিবারের জন্য ১০ লিটার ঘোল ও ১০ লিটার মাঠা কিনে নিয়ে যাচ্ছি।

সিরাজগঞ্জ শহর থেকে ঘোল কিনতে আসা মৌসুমী ব্যবসায়ী জিয়া শেখ বলেন, পুরো রমজান মাস এখান থেকে ঘোল ও মাঠা কিনে নিয়ে এলাকায় বিক্রি করি। প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ মণ ঘোল এলাকায় বিক্রির জন্য নিয়ে যায়। অন্যান্য জায়গার ঘোলের চেয়ে এখানকার ঘোলের দাম প্রতি কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি হলেও এর কদর সবচেয়ে বেশি।

স্থানীয় প্রবীণেরা বলেন, উল্লাপাড়ার সলপ রেলওয়ে স্টেশনের পাশে বাংলা ১৩২৯ সালের (ইংরেজি ১৯২২) ৭ বৈশাখ এই বিশেষ ঘোল তৈরির সূচনা করেন বেতবাড়ি গ্রামের সাদেক আলী খান। সলপের তদানীন্তন প্রভাবশালী জমিদাররা এ ঘোল তৈরিতে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। সাদেক আলী খানের নাতি আব্দুল মালেক তার ছোট ভাই আব্দুল খালেককে সঙ্গে নিয়ে পূর্বসূরিদের হাত ধরে নেমেছেন ঘোলের ব্যবসায়। ধরে রেখেছেন এর প্রাচীন ঐতিহ্য। রমজান মাসে এই ঘোলের চাহিদা প্রতি বছর বেড়ে যায় দ্বিগুণ।

ঘোল উৎপাদনকারী আব্দুল খালেক জানান, রমজান মাসে সলপের ঘোলের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। রমজানের আগে ঘোলের চাহিদা ছিল প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ মণ। রোজায় এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ মণ। ভরা ব্যবসার সময়ে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ঘোল উৎপাদন করতে পারছেন না তারা। এলাকার মানুষকে ফেরাতে না পারলেও দূরদূরান্ত থেকে ঘোল কিনতে আসা অনেক ছোট ব্যবসায়ীকে প্রতিদিন ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। দুধের সংকট রয়েছে এলাকায়। চাহিদা পূরণ করতে পারলে উৎপাদন আর বিক্রির অঙ্কটা আরও বড় হতো। সঙ্গে লাভের অঙ্কটাও।

উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. উজ্জ্বল হোসেন জানান, সলপের ঘোলের জনপ্রিয় বেশি। রমজান মাসে এখান কার ঘোলের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। দূরদূরান্ত থেকে পাইকার ও খুচরা ক্রেতারা আসেন ঘোল ও মাঠা কিনতে। তার সঙ্গে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে এবং ঘোলের গুণগতমান যেন ঠিক থাকে, সে জন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে কড়া নজরদারি করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০