আবু সালেহ মোহাম্মদ মুসা: বিশ্বব্যাপী কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইলের ছড়াছড়ি। এই সহজলভ্যতার কারণে বেড়ে চলছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা। আর সে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে সাইবার অপরাধ, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে অপরাধের সংখ্যা বেশি বাড়ছে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েরাই এসব প্রতারণার শিকার হচ্ছে বেশি। প্রযুক্তির উৎকর্ষে মানুষের স্বাভাবিক চলাচল সীমাবদ্ধ হচ্ছে এবং দিনে দিনে তা আরও প্রকট হচ্ছে। ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী, মাঠে ময়দানে খেলাধুলা আজ কমে যাচ্ছে, বিশেষভাবে শহর এলাকায়। অনলাইন গেমসে আসক্ত শিশুরা দিনে দিনে ঘরবন্দি হয়ে পড়ছে। গেমিংয়ের নেশায় আচ্ছন্ন এসব শিশু সাইবার আক্রমণের শিকার হচ্ছে। না-বুঝে, না-চিনে একেবারে হাতের মুঠোয় অপরাধ ও অনৈতিক জীবনযাত্রায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। এ চলাচল অব্যাহত থাকলে সাইবার আক্রমণের শিকার হয়ে শিশুদের উন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য।
শিশুমন সবসময়ই নতুনের প্রতি আকৃষ্ট। এই আকর্ষণকে লক্ষ্য রেখে বিভিন্ন গেমস ও শিশুদের পছন্দের বিষয়ে টেনে নিতে মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটারের মাধ্যমে ইন্টারনেটে চলে মুক্ত বিচরণ। এভাবেই একসময় শিশুরা বুলিংয়ের শিকার হয়। অনলাইনে শিশুকে প্রলুব্ধ করা, হেয় প্রতিপন্ন করা, ভয় দেখানো, মানসিক নির্যাতন করাই হচ্ছে বুলিং। এ থেকে শিশুর মধ্যে হতাশা, হীনম্মন্যতা, লেখাপড়ার প্রতি অনীহা, ইনসমনিয়া এবং একসময় তা তাকে অপ্রকৃতিস্থ করে তুলতে পারে ও আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি করে। সাধারণত বড়রা নিজেকে আড়াল করে ছোটদের বন্ধু সেজে এ পথে তাদের এগিয়ে দেয়। ই-মেইল ও ফোন কলের মাধ্যমেও এ বুলিং হতে পারে। ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের একটি বড় অংশ এখন হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, তাই সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে বাবা-মাই পারে সন্তানকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে। সন্তানকে বিপদগামী হতে রক্ষা করতে অভিভাবকদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে।
কভিডকালে বড়দের চেয়ে শিশুরা বেশি ঘরে বন্দি হয়ে যায়, ফলে শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। তাই এ সময় শিশুদের সাইবার বুলিং বা হয়রানির শিকার বেশি হতে দেখা গেছে। সুইজারল্যান্ডসের জেনেভাভিত্তিক জাতিসংঘের সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস ইউনিয়ন (আইটিইউ) বলেছে, করোনায় শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় সাইবার বুলিং বা হয়রানির ঝুঁকি অনেকগুণ বেড়েছে। সাইবার সন্ত্রাসীরা অনলাইন গেমসের মাধ্যমে শিশুদের পর্নোগ্রাফির ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে। আমাদের সাইবার নিয়ন্ত্রণ আইনের ফাঁক গলে অপরাধীরা খুব সহজেই নিজেদের দৌরাত্ম্য বাড়িয়ে তুলছে। আমাদের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এক্ষেত্রে তাদের জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিটিআরসির প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, এখন দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ২৭ লাখ ১৩ হাজার আর মোবাইল সিম ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। আমাদের দেশ মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যায় বিশ্বে দশম। বর্তমানে আমাদের গ্রাহকের সংখ্যা ১৩ কোটির বেশি। এমন পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব, গুগলের মতো জনপ্রিয় সেবাগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এ মাধ্যমগুলো দ্রুত সঠিকভাবে সাইবার ক্রাইম আইনের আওতায় আসা জরুরি যাতে অনলাইনে ব্যবহারকারীরা নিরাপদে বিচরণ করতে পারেন। কারণ তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার ইন্টারনেট ছাড়া বিশ্ব অচল। কাজেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এটিকে সবসময়ই গতিশীল রাখতেই হবে এবং এ সঙ্গে শিশুরা যাতে না বুঝে ভুল পথে না যেতে পারে সেদিকে দৃষ্টি দেয়া জরুরি, মনে রাখতে হবে ওরাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
শিশুদের অনলাইনে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ গেমস। গেমস কিনে খেলতে বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকেই পাইরেটেড গেমস ডাউনলোড করে সাধারণত গেমস খেলে থাকে। সাইবার সন্ত্রাসীরা এ বিষয়টি মাথায় রেখে পাইরেটেড গেমসের মধ্যে ম্যালওয়্যার ইন্সটল করে দেয়, যাতে ব্যবহারকারীর কম্পিউটারে সাইবার সন্ত্রাসীরা সহজেই ঢুকে তাদের কার্যক্রম সহজে জোরদার করতে পারে। অন্যদিকে দীর্ঘক্ষণ বসে ও কম্পিউটারের স্ক্রিনে চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকায় মানসিক চাপ বৃদ্ধির সঙ্গে ধমনীতে রক্ত জমাট বাঁধা, হার্টের সমস্যা, লিভারের সমস্যা, চোখের সমস্যা, ক্যানসার, কারপাল টানেল সিনড্রোমসহ স্বাস্থ্য সমস্যার আলোকে মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সাধিত হতে পারে। তাই সার্বিক বিবেচনায় সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে সরকারের আইনের আরও প্রসারিত করার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের, প্রচারের, ব্যবস্থা গ্রহণের এবং সব অভিভাবকের সন্তানের অনলাইনে গতিবিধি লক্ষ্য রাখতে হবে আমাদের সন্তান যেন বিপদগামী না হতে পারে, সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং এ লক্ষ্যে কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তি বা ইন্টারনেট আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা আমাদের জীবন ব্যবস্থা এখন ইন্টারনেট ছাড়া ভাবতে পারি না। পড়াশোনা, খেলাধুলা, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, কেনাকাটা সবকিছুতে এখন তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে এবং দীর্ঘমেয়াদি মহামারির কারণে অনলাইন নির্ভরতা গত এক বছরে তিন থেকে চার গুণ বেড়েছে। নির্ভরশীল জনসংখ্যার এক বড় অংশ হচ্ছে শিশু, যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। ইউনিসেফ, টেলিনর ও গ্রামীণফোন ২০১৮ সাল থেকে শিশুদের নিরাপদ ইন্টারনেট সেবা দেয়ার জন্য একসঙ্গে কাজ করছে। ৫০০টি স্কুলে ইতোমধ্যে সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে ২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ শিশুর কাছে সরাসরি পৌঁছাতে পেরেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুরা যেন ইন্টারনেট সহজে ও নিরাপদে ব্যবহার করতে পারে, সেদিকে আমাদের মনোযোগী হতে হবে। শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে মা-বাবা, শিক্ষক, অভিভাবক সবার নজরদারি প্রয়োজন এবং তা তাদের সবার দায়িত্বও বটে। ইতোমধ্যে সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রেডিও, টেলিভিশন ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে শিশুদের সচেতনতায় কাজ করেছে। বিভিন্ন আলোচনায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠক্রমে অনলাইন নিরাপত্তার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে জোর দেয়া হয়েছে এবং ইউনিসেফ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছে। এছাড়া মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে তাদের কাজগুলো বাস্তবায়িত করছে। এসব কার্যক্রমে পুলিশ বাহিনী যথাযথ সহযোগিতা করেছে, অনেক নাগরিক সংগঠনও এগিয়ে এসেছে। সরকারের দিক থেকে বিটিআরসি, পুলিশ বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবার ভূমিকা রয়েছে। ইতোমধ্যে একটি উদ্যোগের মাধ্যমে ২২ হাজার পর্নোগ্রাফি সাইট বন্ধ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম, ফেসবুক, ইউটিউবসহ ব্যক্তি পর্যায় থেকে কিছু না কিছু সচেতনতামূলক ভূমিকা রাখা দায়িত্ব। ফেসবুক, ইউটিউব এখনও আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ভারত ও অস্ট্রেলিয়া এটা নিয়ে আইন করেছে, আমাদেরও উচিত কঠোর আইনের মাধ্যমে সাইবার আক্রমণ রোধে নজরদারি বাড়িয়ে যুগোপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
শিশুদের তথ্যপ্রযুক্তি বইতে সাইবার বুলিংসহ এ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য থাকলে শিশুরা সচেতন হবে। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে অনেক শিশু বিষণœ থাকে। পাশাপাশি অনলাইনে ক্লাস পরিচালনার জন্য শিক্ষকদের আরও বেশি প্রশিক্ষিত হতে হবে। অনেক অভিভাবকের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা না থাকায় তারা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছেন না। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পড়ালেখার পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যম, গেমস ও চ্যাটিংয়ের জন্য প্রতিদিন শিশুরাও তাদের অনেক সময় ইন্টারনেটে ব্যয় করছে। শিশুরা এক্ষেত্রে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই তারা জানে না, যা তাদের বিপদগামী হওয়ার আশঙ্কাকে বাড়িয়ে তুলে অনেক বেশি। তাই এর ব্যবহার সম্পর্কে অভিভাবকদের অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে, যেন শিশুদের নিরাপদে ইন্টারনেটে বিচরণ নিশ্চিত করা যায়। এক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পুলিশ প্রশাসন, আইটি বিশেষজ্ঞ, সবাইকে নিয়ে একটা নীতিমালা তৈরি করা প্রয়োজন। এক গোলটেবিল আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে।
ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, সাইবার ক্রাইম বন্ধে রি-অ্যাকটিভ ও প্রো-অ্যাকটিভ-দুইভাবেই কাজ করছে তারা। যখন কোনো সাইবার অপরাধ সংঘটিত হয়, তখন ভিকটিমকে প্রতিকার প্রদানে, সাইবার অপরাধ দমনে বাংলাদেশ পুলিশের কয়েকটি ইউনিট কাজ করে। ডিএমপির সিটিটিসি ইউনিটে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনে একটি হেল্পডেস্ক আছে, যা সার্বক্ষণিক সেবা প্রদান করে থাকে, যে কেউ এখানে প্রয়োজনীয় পরামর্শের জন্য সরাসরি আসতে পারেন, কাউন্সেলিং বা পরামর্শসেবা দিয়ে সাইবার অপরাধ থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিরত রাখা জরুরি। এছাড়া বিভিন্ন থানায় দায়ের করা মামলা এই ডিভিশন তদন্ত করে থাকে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্সও দিয়ে থাকে। এছাড়া রয়েছে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার। এর অত্যাধুনিক ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব দ্রুততার সঙ্গে মামলা নিষ্পত্তিতে সহায়ক হচ্ছে।
এভাবেই সবার সচেতনতা এবং সতর্কতা সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে সহায়ক হবে এবং নিশ্চিত করবে শিশুর স্বাভাবিক এবং নিরাপদ জীবনযাত্রা। শিশু সহজ সরল আনন্দময় পথে জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবে। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে নতুন নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং সুখী প্রজন্ম দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
পিআইডি নিবন্ধ