সাউন্ড সিস্টেম আমদানিতে ‘তুঘলকি কাণ্ড’

রহমত রহমান: আমদানি পণ্যের ‘বর্ণনা’ পরিবর্তন করা হয়েছে। পরিবর্তন করা হয়েছে ‘এইচএস কোড’। এখানেই শেষ নয়। দুই থেকে সাড়ে আট হাজার ডলারের পণ্যের শুল্কায়ন মূল্য ঘোষণা দেয়া হয়েছে মাত্র ৯৫ ডলার। সাউন্ড সিস্টেম আমদানিতে এমন তুঘলকি কাণ্ড ঘটেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে। মেসার্স ওরিয়েন্ট ইলেকট্রনিকস নামে একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সাউন্ড সিস্টেম আমদানিতে এমন তুঘলকি কাণ্ড ঘটিয়েছে। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তারা পণ্য চালানটি আটক করেন। পরে চালানটি শতভাগ কায়িক পরীক্ষার পর এমন তুঘলকি কাণ্ড বেরিয়ে আসে। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটি এর আগে ৯৫ ডলারের কম মূল্যে শুল্কায়ন করে একটি চালান খালাস নিয়েছে। দুইজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার সহায়তায় তাদের আইডি ব্যবহার করে তড়িঘড়ি করে মাত্র তিন ঘণ্টায় শুল্কায়ন করে খালাস নিয়েছে বলে অন্য এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে এক শ্রেণির অসাধু আমদানিকারক শুল্ককর ফাঁকি দিতে উচ্চমূল্যের সাউন্ড সিস্টেম অতিনি¤œ মূল্য দেখিয়ে কৌশলে খালাস নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

কাস্টমস গোয়েন্দার প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রামের কোতোয়ালি এলাকার আমদানিকারক মেসার্স ওরিয়েন্ট ইলেকট্রনিকস। প্রতিষ্ঠানটি মিউজিক্যাল ইনস্ট্র–মেন্টের (স্পিকার) একটি পণ্য চালান আমদানি করে। যার ওজন দেখানো হয় ১০১৪ দশমিক ৭০ কেজি। চালানটি খালাসের জন্য ১৪ এপ্রিল বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। চালানে আসা পণ্য মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা হয়েছেÑএমন তথ্যের ভিত্তিতে চালানটির খালাস স্থগিত করে কাস্টমস গোয়েন্দা। পরে ৯ মে চালানটি শনাক্ত করে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করা হয়। যাতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠান ৮৫১৮২২০০ এইচএস কোডে ১০১৪ দশমিক ৭০ কেজি ওজনের মিউজিক্যাল ইন্সুট্র–মেন্ট (স্পিকার) ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আর কায়িক পরীক্ষায় পাওয়া গেছে সাউন্ড সিস্টেম (স্পিকার), যার সঠিক এইচএস কোড হবে ৮৫১৮৫০০০। আর কায়িক পরীক্ষায় পণ্যের ওজন পাওয়া যায় ১১০৮ দশমিক ৬৪ কেজি। অর্থাৎ ঘোষণার চেয়ে ৯৩ দশমিক ৯৪ কেজি পণ্য বেশি পাওয়া গেছে, যা ঘোষিত পণ্যের ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ বেশি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা বিভিন্ন ধরনের স্পিকারের প্রতিটির শুল্কায়ন মূল্য দেখানো হয়েছে ৯৩ দশমিক ১৩ ডলার। তবে কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এসব স্পিকারের মূল্য অ্যামাজনসহ কয়েকটি অনলাইনে যাচাই করেন। যাতে দেখা গেছে, স্পিকার কোরন একে৬-এর (এসটিডি সাইজ) শুল্কায়ন মূল্যে আমদানিকারক দেখিয়েছে ৯৫ দশমিক ১৩ ডলার। আর অনলাইনে এর মূল্যে দেখা গেছে ৮ হাজার ২৪৯ ডলার। অর্থাৎ এই স্পিকারে ৮ হাজার ১৫৩ ডলার কম দেখানো হয়েছে। একইভাবে স্পিকার কোরন একে৬-এর (স্মল সাইজ) শুল্কায়ন মূল্যে আমদানিকারক দেখিয়েছে ৯৫ দশমিক ১৩ ডলার। আর অনলাইনে এর মূল্যে দেখা গেছে ৮ হাজার ২৪৯ ডলার। স্পিকার ল্যাসকালা এএল৫-এর (এসটিডি সাইজ) মূল্য দেখানো হয়েছে ৯৫ দশমিক ১৩ ডলার। অনলাইনে এর মূল্য দেখা গেছে ৬ হাজার ৫৯৯ ডলার। স্পিকার ল্যাসকালা এএল৫-এর (স্মল সাইজ) মূল্য দেখানো হয়েছে ৯৫ দশমিক ১৩ ডলার। অনলাইনে এর মূল্য দেখা গেছে ৬ হাজার ৫৯৯ ডলার। স্পিকার আরএফ৭১১১ কলার-এর (ব্লাক) মূল্য দেখানো হয়েছে ৯৫ দশমিক ১৩ ডলার। অনলাইনে এর মূল্য পাওয়া গেছে ৪ হাজার ৩৯৮ ডলার। স্পিকার আরএফ৭১১১ কলার-এর (ওয়ালনাট) মূল্য দেখানো হয়েছে ৯৫ দশমিক ১৩ ডলার। অনলাইনে এর মূল্য পাওয়া গেছে ৪ হাজার ৩৯৮ ডলার। স্পিকার আরসি-৬৪১১১ কলার-এর (ওয়ালনাট) মূল্য দেখানো হয়েছে ৯৫ দশমিক ১৩ ডলার। অনলাইনে এর মূল্য পাওয়া গেছে এক হাজার ৮২৯ ডলার। প্রতিষ্ঠানটি অতিনি¤œ মূল্য দেখিয়ে শুল্ককর ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। পণ্যের বর্ণনার পরিবর্তন ও মিথ্যা এইচএস কোডে পণ্য শুল্কায়ন এবং বাজার মূল্য অপেক্ষা কম মূল্য ঘোষণা দেয়ায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২৩ মে চট্টগ্রাম কাস্টম কমিশনারকে এই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দিয়েছে কাস্টম গোয়েন্দা।

অন্যদিকে, একই আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান জালিয়াতির মাধ্যমে ৩১ মে একটি চালান খালাস নিয়েছে বলে অন্য একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অসত্য এইচএস কোড ও অতিনি¤œ মূল্যে শুল্কায়ন করে শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে একটি চালান খালাস নেয়ার চেষ্টা করে আমদানিকারক মেসার্স ওরিয়েন্ট ইলেকট্রনিকস। ন্যায় নির্ণয়ের মাধ্যমে শুল্কায়ন করে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২৩ মে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কমিশনারকে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো ন্যায় নির্ণয় করে শুল্কায়ন সম্পন্ন করা হয়নি। তবে ৩১ মে একই প্রতিষ্ঠান একটি বিল অব এন্ট্রিতে (বি/ই ৯৬৫২২৩) জালিয়াতি করে একটি চালান খালাস নিয়েছে। যাতে আটক করা পণ্য মূল্যের চেয়েও (৯৫.১৩ ডলার) খালাস নেয়া পণ্য মূল্য কম (৭৬ ডলার) দেখানো হয়েছে। অ্যাসাইকুডা সিস্টেম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আমদানিকারকের মনোনীত সিএন্ডএফ এজেন্ট বিল অব এন্ট্রি রেজিস্টার করার আগে সাতবার মডিফাই (পরিবর্তন) করেছেন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রথমে স্টোর করা বিল অব এন্ট্রি কাস্টমস গোয়েন্দা লক করে। কিন্তু সিএন্ডএফ এজেন্ট পরবর্তীকালে বিএল নম্বরসহ পণ্যের বর্ণনা ও মডেল একাধিকবার পরিবর্তন করে ৩১ মে রেজিস্টার করে। পরবর্তী ৩ ঘণ্টার মধ্যে কাস্টম হাউসের শুল্কায়ন গ্রুপের কর্মকর্তাদের সহায়তায় শুল্কায়ন করে খালাস নেয়। শুল্কায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের আইডি ছিল সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা রাশেদ ও রোকনুজ্জামানের। কাস্টমস গোয়েন্দার লক করার পর শুল্কায়ন গ্রুপের কর্মকর্তারা তা অবহিত হয়েছে। এরপরও কীভাবে শুল্কায়ন করে মাত্র ৩ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য খালাস নিয়েছেÑতা নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে।

এ বিষয়ে মেসার্স ইলেকট্রনিকসের কর্মকর্তা আবু তাহের মিথ্যা ঘোষণা ও এইচএস কোড পরিবর্তনের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাদের কোনো মাল কখনোই মিস ডিক্লারেশন দেয়া হয়নি।’ ৮২৪৯ ডলারের সাউন্ড সিস্টেম কীভাবে ৯৫ ডলারে শুল্কায়নের জন্য ঘোষণা দিয়েছেন কি নাÑএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা যে ঘোষণা দেয়, কাস্টম হাউস তো তা মেনে নেয় না। কাস্টম হাউস তার নিজস্ব গতিতে ট্যারিফ দেখে শুল্কায়ন করে। আমরা বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা করি। এগুলো তেমন দামি জিনিস না।’ ৩১ মে জালিয়াতি করে ওরিয়েন্ট ইলেকট্রনিকস একটি চালান খালাস নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, বাজার মূল্য আর শুল্কায়ন মূল্যের মধ্যে এত তফাৎ হতে পারে না। প্রতিষ্ঠানটি সিএন্ডএফ ও অসাধু কিছু কর্মকর্তার সহায়তায় শুল্ককর ফাঁকি দিতেই এমন তুঘলকি কাণ্ড ঘটিয়েছেন। প্রতিবেদন দেয়ার পরও কাস্টম হাউস কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে প্রতিষ্ঠানটি কয়েকদিন পর অন্য একটি চালানে শুল্ককর ফাঁকি দিতে দুই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার সহায়তায় অসৎ উপায় অবলম্বন করে পণ্য খালাস নিয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে কমিশনারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। অন্যদিকে, এই বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের একাধিক কর্মকর্তাকে ফোন করা হলেও কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০