সাকুলেৎ শ্রেণির অধিকার কোথায়?

চয়ন বাবু: ফরাসি বিপ্লবকে পৃথিবীর ইতিহাসে যুগান্তকারী বিপ্লব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ‘সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা’ এই সেøাগানকে বুকে লালন করে সংঘটিত হওয়া এই বিপ্লব টি ফ্রান্স তথা পুরো ইউরোপের পট পরিবর্তন করে দিয়েছিল। ফলে ফ্রান্সের জনগণ তাদের কথা বলার অধিকার ফিরে পায়। ফিরে পায় তাদের সব সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার।

দুঃখজনক হলেও সত্য সমালোচকরা আজও ফরাসি বিপ্লবকে বুর্জোয়া বিপ্লব বলে সমালোচনা করেন। কারণ এ বিপ্লব ফ্রান্সের সব শ্রেণি-পেশার জনগণের দ্বারা সংগঠিত হলেও এর ফলাফল লুফে নিয়েছিল তৎকালীন বুর্জোয়া শ্রেণি। আর বঞ্চিত হয়েছিল বিপ্লবের প্রাণশক্তি সেই সাকুলেৎ শ্রেণি। ফরাসি বিপ্লবের আঁচ পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লেও সাকুলেৎ শ্রেণির ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। মূলত তাদের ভাগ্য অপরিবর্তিতই থেকে গিয়েছিল।

শুধু ফরাসি বিপ্লবই নয় বরং বিশ্বের ইতিহাসে যত বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে; সবগুলোর প্রাণশক্তি ছিল সাকুলেৎ তথা ওই সময়ের ভাসমান শ্রেণি কিন্তু বিপ্লব পরবর্তী তারাই উপেক্ষিত থেকে গেছে সবসময়।
আমাদের দেশের দিকে তাকালে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের ১৯০ বছরের শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জš§ হয়। ব্রিটিশবিরোধী সব আন্দোলনে অবদান ছিল এ দেশের ফকির সন্ন্যাসী সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বেশি। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর এ দেশের মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি বরং কিছু ক্ষেত্রে তাদের ওপর বৈষম্য আরও বেড়ে গিয়েছিল।
এসবের বিরুদ্ধে আবার এ দেশের সাধারণ মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধে। তাদের লক্ষ্য ছিল সাম্য, ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদার ওপর ভিত্তি করে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। দেশ স্বাধীন হয়েছিল ঠিকই কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন খুব একটা হয়েছিল কি? তারা ন্যায়বিচার আর মানবিক মর্যাদা পেয়েছিল কি প্রশ্নটা রাখাই যায়। তারা তাদের অধিকার পায়নি বরং তারা বঞ্চিতই থেকে গেছিল স্বৈরশাসন আর সামরিক শাসনের নাগপাশে।

২০২৪ সালে ছাত্রজনতার নেতৃত্বে দেশের আম-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হয়। এর মাধ্যমে দেশের মানুষ তাদের কথা বলার অধিকার ফিরে পেয়েছে। তাদের সব অধিকার যথাযথ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে। আজকে সবাই সবার অধিকার নিয়ে কথা বলছে।
কিন্তু একটা জায়গায় গিয়ে সেই ফরাসি বিপ্লব পরবর্তী সাকুলেৎ শ্রেণির সঙ্গে আমার দেশের ভাসমান শ্রেণির একটা অদ্ভুত মিল পাচ্ছি। দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হওয়ার আজ ৫০ দিন পার হলো। বর্তমান সরকার অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও দেশের ভাসমান শ্রেণির ভাগ্যের উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে আমার চোখে পড়েনি। পদক্ষেপ তো দূর তাদের ব্যাপারে সরকার, মানবাধিকার কর্মী, মিডিয়া, নেটিজেন কাউকেই কোনো জোরালো বক্তব্য দিতে দেখিনি। কেন এখনো তাদের অধিকার নিয়ে কেউ কথা বলছে না আমার জানা নেই। তবে এ কথা আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে এই আন্দোলনে আমাদের ভাসমান শ্রেণির অবদান কোনো অংশে কম ছিল না বরং সবার চাইতে একটু বেশিই ছিল। এখন যদি তাদের অধিকার নিয়ে আমরা দূতসভার মহাজ্ঞানীদের ন্যায় মৌন থাকি তবে বাস্তবিক অর্থে দেশের উন্নয়ন কখনই হবে না।
দেশের এই লক্ষ্মীছাড়া, গৃহহারাদের ব্যাপারে সবাই যখন মৌন তখন বিকর্ণের মতো তাদের হয়ে কিছু কথা বলাটা এখন নিজের দায়িত্ব মনে করছি।

সত্য কথা বলতে আপনি যদি ট্রেনে যাতায়াত করেন কিংবা আপনার যদি রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেনের জন্য বসে থাকার সুযোগ হয় আপনি প্রতিটি রেলওয়ে স্টেশনেই কিছু মানুষকে দেখতে পাবেন। এই মানুষগুলোর স্থানী কোন ঠিকানা নেই, স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম এদের ঘর। রাত ১২টার পর প্ল্যাটফর্মগুলো যখন একটু ফাঁকা হয় তখন এরা খোলা আকাশের নিচে খালি মাথায় ঘুমাতে যায়। বিমানবন্দর স্টেশনে এখনও দেখা যায় তিন থেকে চার বছরের শিশু খালি গায়ে, হাতে,পায়ে ময়লা নিয়ে খেলা করছে। ওই শিশুদের বাবা কে ওর মা কে আমরা খুঁজে দিতে পারব? রাত ১২টার পর দেশের বড় বড় জংশন রেলওয়ে স্টেশনগুলোতে দেখা যায় কমপক্ষে শত শত গৃহহীন মানুষ খোলা আকাশের নিচে ঘুমাচ্ছে।

দেশের এত মানুষ এখনও খোলা আকাশের নিচে ঘুমায় এত মানুষ গৃহহীন এই বিষয়টি আমরা কীভাবে সহ্য করি! শুধু জংশন-স্টেশন নয় বরং দেশের প্রতিটি ছোট বড় রেলওয়ে স্টেশন, ফুটপাত, বাসস্ট্যান্ড, ওভারব্রিজে লাখ লাখ গৃহহীন ছন্নছাড়া মানুষ যাদের বড় একটা অংশ শিশু, বৃদ্ধ, নারী এরা ঘুমায় অথচ দেশের কোন নিউজ চ্যানেলে তাদের নিয়ে ভালো করে একটা নিউজ হতে গত ১৫ বছর তো দেখিনি এখনো দেখছি না। কোনো অধিকার কর্মীকে এই অস্পৃশ্য মানুষগুলোর অধিকার নিয়ে কথা বলতে শুনছি না, কোনো টকশোতে এদের নিয়ে আলোচনা হতে শুনছি না। তাদের নিয়ে আলোচনা করা তো দূর তাদের অধিকার আদায়ের কথা বলাতো দূর আমরা সুবিধাভোগী সমাজ এই লক্ষ্মীছাড়া, গৃহহীন, সুবিধা বঞ্চিত মানুষগুলোকে টোকাই বলে এড়িয়ে যাই। এই মানুষগুলোর অধিকারের ব্যাপারে সচেতন না হয়ে বরং আমরা এই মানুষগুলোর ব্যাপারে সচেতন থাকি, কারণ আমরা জানি এই টোকাইগুলো চোর হয় এরা সুযোগ পেলে ভদ্র-সুবেশীদের মালপত্র চুরি করে কিন্তু কেউ জানে না তাদের কে চোর বা অপরাধী বানিয়েছে এবং তাদের অধিকার না দিয়ে চোর বা অপরাধী বানানো হচ্ছে।

তিন-চার বছরের শিশুর কী অপরাধ আর পাঁচটা শিশুর মতো তার কি সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার নেই। সুন্দরভাবে বাঁচা তো দূর আর কিছুদিন পর হয়তো ওর মা ওকে ছেড়ে যাবে হয়তো শিশুটা বাঁচার তাগীদে আমাদের কারও খাবার চুরি করবে তারপর হয়তো কোনো একদিন ধরা পড়লে গণ-পিটুনিতে তার প্রাণ যাবে তোফাজ্জলের মতো। এভাবেই তাদের জীবন চক্র শেষ হবে। কিন্তু তাদের জীবনের এই অবহেলা দায় কি কোনোভাবে এড়ানোর সুযোগ আছে কি? এতো একদল গৃহহীন মানুষের দৃশ্য দেশে এরা ছাড়া আরও কত অস্পৃশ্য মানুষ যে অধিকার বঞ্চিত আছে এটা বোধহয় আমাদের কল্পনার ও বাইরে। ১৯৪৭ এ দেশভাগের সময় যেসব দলিত মানুষ এদেশকে সমর্থন করেছিল তারা কি তাদের ন্যূনতম মানবিক অধিকার পেয়েছে তারা কি দেশের অন্য নাগরিকদের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে, আজকে দেশের দ্বিতীয় অর্থকারী ফসল চা কিন্তু চা শ্রমিক কি তার জীবন ধারণের ন্যূনতম মজুরিটুকু পায়, দেশের অর্থনীতিকে চাঙা রাখা গার্মেন্টস কর্মীদের জন্য সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ কি আমরা তৈরি করতে পেরেছি, আমরা নিজেকে গর্ব করে বলি মাছে ভাতে বাঙালি আমরা কি কখনো জেলেদের জীবন কিভাবে চলে এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি, হিজড়া জনগোষ্ঠীকে কেন এখনও ট্রেনে চাঁদা তুলে জীবন ধারণ করতে হবে এ প্রশ্ন কি আমরা তুলছি, একজন দিনমজুরের কাজ বন্ধ থাকলে তার জীবন কীভাবে চলবে এর জন্য আমরা কি কোনো বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারছি, এমনকি একজন কৃষক কি তার চাষাবাদের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তার প্রাপ্য সুবিধা টুকু পাচ্ছে?

এই ভাসমান মানুষগুলোকে নিয়ে এতদিন তো কেউ কথা বলেননি বরং ২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানের পরও যদি কথা বলা না হয় তাদের অধিকার টুকু পাইয়ে দেয়া না হয়, তাদের যথাযথ পুনর্বাসন করা না হয় তবে বুঝতে হবে ফরাসি বিপ্লবের মতো আমাদের ২৪ এর গণ-অভ্যুত্থান ও মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির অধিকার কেই সংরক্ষণ করবে মাত্র, এটি অস্পৃশ্য, ভাসমান, গৃহহারা, লক্ষ্মীছাড়া মানুুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারবে বরং তাদের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য আবার হয়তো কবি নজরুলের মতো কাউকে এভাবে ডাক দিতে হবে, ‘এসো আমার লক্ষ্মীছাড়া গৃহহারা ভাইরা! আজ ঝর ঝর বারিধারার সুরেসুরে কান্না উঠেছে- হায় গৃহহীন হায় পথবাসী হায় গতিহারা! এই আকাশ ভাঙ্গা আকুল ধারার মাঝে নাঙ্গা, শিরে আদুল গায়ে বেরিয়ে এসো; বেরিয়ে এসো আমার পথের সাথীরা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০