শফিকুল ইসলাম খোকন: পরিচ্ছন্নতা, পরিষ্কার মানুষের জন্য অপরিহার্য একটি বিষয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মানুষের মনকে চাঙ্গা করে, মনকে সতেজ করে। মন যদি খারাপ হয় তখন কিছুই ভালো লাগে না। মন ভালো করার জন্য প্রথম উপায় হলো নিজে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন থাকা। হ্যাঁ, নিজে ভালো থাকলেই হবে না, পরিবার সমাজকেও ভালো রাখতে হবে। একজন সচেতন মানুষের জন্য হলো নিজে ভালো থাকা, পরিবারসহ সমাজকে ভালো রাখা। আমাদের সমাজে এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা বা রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেভাবে শুরু হয়েছে তা থেকে যেমন বের হওয়ার সুযোগ কম, তেমনি আমাদের সমাজ এবং পরিবেশের অবস্থাও খুবই খারাপ। নগরের চেয়েও আমাদের উপকূলীয় অবস্থা খুবই খারাপ। সমাজ কীভাবে পরিচ্ছন্ন রাখা যায় এটা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথাই নেই। দেশের কর্তারা শুধু শহরকেন্দ্রিক ভাবতে ভাবতে শেষ, উপকূল নিয়ে ভাবার সময় তাদের কোথায়। সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই নষ্ট সমাজ থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের উপকূলকে পরিচ্ছন্ন করলে সুরক্ষা হবে সবকুল।
অনেক মানুষই জানেন না, উপকূল কী? অথচ উপকূলে বসবাস লাখ লাখ মানুষের। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব প্রায় পুরোটাই আসলে উপকূল। উপমহাদেশের মানুষ যেমন পাহাড় বলতে এভারেস্ট বুঝে, বাংলাদেশের মানুষ উপকূল বলতে কক্সবাজারকেই বুঝে। আসলে এর ব্যাপ্তি অনেক বড়। বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরমুখী মূল ভূখণ্ড পুরোটাই উপকূল; দেশের ১৯ জেলা নিয়ে বাংলাদেশের উপকূল। ৭০০ কিলোমিটারের অধিক এই উপকূলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখো মানুষের জীবন-জীবিকা। উপকূলে যে শুধু ঝড়, জলোচ্ছ্বাস আর দুর্যোগ তা নয়, উপকূলে রয়েছে মৎস্য, পর্যটন সম্ভাবনার জায়গা। সেই সম্ভাবনা জায়গা অসচেতনতায় এখন প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্যে ভরে উঠছে সমুদ্রের পাড়। প্রতিনিয়তই দূষণের শিকার হচ্ছে আমাদের সমুদ্র উপকূল।
১৬ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক উপকূল পরিচ্ছন্নতা দিবস। আমাদের দেশে বিভিন্ন দিবস আয়োজনের নামে টাকা লোপাট হচ্ছে, ব্যানার, ফেস্টুন আর শোভাযাত্রা দিয়েই সীমাবদ্ধ। অথচ আমাদের দেশে অনেক কিছুই আছে গবেষণা করে নতুন নতুন বিষয় উদ্ভাবন করা। উপকূল নিয়ে আমাদের কোনো ভাবনাই নেই। এত সম্ভাবনার জায়গা উপকূল দিন দিন ধংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের উদাসীনতায়। ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলছে, তাছাড়া অসচেতনতা তো রয়েছেই। অথচ দেশের উপকূলীয় এলাকার হোটেল, মোটেল ও রেস্তোরাঁয় একবার ব্যবহারের পর বর্জ্য হয়ে যায় এমন প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার বন্ধের নির্দেশনাও রয়েছে হাইকোর্টের। কিন্তু, এ নির্দেশনা অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তর যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ায়, এটি দিনদিন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে যা করা দরকার, পরিবেশ অধিদপ্তরের তা করতে না পারার কোনো কারণ নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় তারা সহজেই সরেজমিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং যারা এ আদেশ মানছে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। অন্তবর্তীকালীন সরকারের কঠোর নির্দেশনাও রয়েছে। পর্যটনের জন্য উপকূলে বেড়াতে যাওয়া মানুষের ফেলে আসা ময়লা-আবর্জনা, যাকে বলা হয় ‘অ্যানথ্রপোজেনিক মেরিন ডেবরি’ই হলো উপকূলসহ সমুদ্রদূষণের প্রধান কারণ।
একজন পর্যটক একটা চিপসের প্যাকেট ফেলে এলে আর কী আর ক্ষতি হতে পারে! এখানে ফেলে আসা প্যাকেটের সংখ্যা একটা বড় ব্যাপার। আবার ফেলে আসা চিপসের প্যাকেট বা যেকোনো ধরনের প্যাকেট-মোড়ক বা প্লাস্টিকে তৈরি যেমন সিগারেটের ফিল্টার একসময় পানিতে গিয়ে পড়ে। এ পানি বরগুনার উপকূল হলেও যা, কক্সবাজারের সমুদ্রও হলেও তা-ই। পানিতে পড়লে তা পানির উপরিভাগে যত দিন থাকে ততদিন রোদে পুড়তে থাকে। এতে প্লাস্টিকের আন্তরাণবিক গঠনে পরির্বতন আসে। এ সত্য আমরা সবাই জানি। পানি গরম হলে বাষ্প হয়। তাই পানিতে পড়া প্লাস্টিকের কোনো কিছুর ভঙ্গুরতা বাড়তে থাকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। মানে নরম হওয়া শুরু করে। এতে অবশ্য সময় লাগে। কিন্তু শেষমেশ এটাই হয়। একটি প্লাস্টিকের মোড়ক বা পণ্য ভাঙতে শুরু করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হতে থাকে। এটা এত ছোট হতে পারে যাকে আর চোখে দেখাও সম্ভব হয় না। একে তখন বলা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক; যা পানির সঙ্গে মিশে যেতে পারে। আর পানিবাহিত হয়ে তা জলজ পরিবেশ দূষিত করে। যেমন আমরা এখন প্রায়ই শুনি মাছের মধ্যে প্লাস্টিক পাওয়া গেছে, মানুষের মল, বুকের দুধে প্লাস্টিক পাওয়া গেছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ আপনার আমার ফেলে দেয়া সিগারেটের ফিল্টার, খাবারের মোড়ক, একবার ব্যবহায্য থালাবাটি, চায়ের কাপ, আর যত যা আছে যা আমরা ফেলে আসি, যা প্লাস্টিকে তৈরি তার সবই।
বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ২০২০ সালে এসে ৯ কেজি হয়েছে, যা ২০০৫ সালে ছিল ৩ কেজি। এসব প্লাস্টিকের বেশিরভাগই শেষ পর্যন্ত সাগরে গিয়ে পড়ে। এটি সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। সুইজারল্যান্ডের বার্ন বিশ্ববিদ্যায়ের জলবায়ু গবেষণাময় সাগরে বিশাল প্লাস্টিক আবর্জনা ঘূর্ণিপাকের দৃশ্যগুলো আতঙ্কের। ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বড় অংশ উপকূলেই রয়ে যায়, যা মারাত্মক ক্ষতিকর। গবেষণায় দেখা যায়, সাগরের প্রায় ৮০ শতাংশ ভাসমান প্লাস্টিক বর্জ্য পাঁচ বছর পরেও উপকূলের কাছাকাছি বা উপকূল থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যেই থেকে যায়। প্রতি বছর প্রায় ১৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক সাগরে যায়, যার বড় একটি অংশ আবার উপকূলে ফিরে আসে। সাগরে ভেসে যাওয়া প্লাস্টিকের কমপক্ষে এক তৃতীয়াংশ আবার উপকূলেই আটকা পড়ছে। যার পরিণতি পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। উপকূলীয় ইকো সিস্টেম প্লাস্টিক দূষণের জন্য বিশেষভাবে সংবেদনশীল এবং পর্যটন খাতেও তার প্রভাব পড়ে।
পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে প্লাস্টিক বর্জ্য এমনিতেই ভয়াবহ। সমুদ্র দূষণের ক্ষেত্রে একক দূষক বস্তু হিসেবে এটি সবার ওপরে। এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে শুধু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন পণ্য পরিবহন ও এর মোড়কে ব্যবহƒত প্লাস্টিক দ্রব্য থেকেই ব্যাপক হারে সমুদ্র দূষণ হয়েছে। ওই বছর এ ধরনের সমুদ্র দূষণকারী প্লাস্টিক জঞ্জালের পরিমাণ ছিল ২২ কোটি ৪০ লাখ পাউন্ড। এতেই বুঝা যাচ্ছে, ৪০০-৫০০ বছরেও পলিথিন বা প্লাস্টিক ধ্বংস হবে না। পলিথিন-প্লাস্টিকের কারণে পানি, বায়ু, মাটি দূষিত হচ্ছে। মাটির উর্বরা শক্তি নষ্ট হচ্ছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় ২০ প্রজাতির মাছের পেটে মাইক্রো প্লাস্টিক পাওয়ার ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে। উপকূলসহ সারাদেশে পলিথিন ও অনটাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে না পারলে অচিরেই পরিবেশের ওপর মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে।
আমাদের সভ্যসমাজে প্লাস্টিক যত্রতত্র ব্যবহার করছি। সমাজে এমন অবস্থা হয়েছে প্লাস্টিকের বোতলের পানি না হলে সমাজ রক্ষা হয় না। দিন দিন এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৩ সালের জুনে পরিবেশ, বন ও জলবায়-পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে বছরে এখন ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ২ লাখ ২৮ হাজার টনের মতো রিসাইকেল বা পুনঃব্যবহার হয়। বাকি বর্জ্য পরিবেশে পড়ে থাকে। সারাদেশের যে বর্জ্য উৎপন্ন হয়, এর ৩০ শতাংশের বেশি হয় রাজধানী ঢাকায়। দেশের প্রধান শহরটিতে বছরে প্রায় আড়াই লাখ টন, অর্থাৎ দিনে ৬৮১ টনের মত বর্জ্য উৎপন্ন হয়। সারাদেশে এর পরিমাণ ২ হাজার ২৫০ টন। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু ৯ কেজি বর্জ্য উৎপন্ন করলেও রাজধানীতে এটি দ্বিগুণ বা ১৮ কেজি। যদিও বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে প্লাস্টিক বর্জ্য পুনব্যবহারযোগ্য করে বিভিন্ন পণ্য তৈরিও করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও প্লাস্টিকমুক্ত করার জন্য বা প্লাস্টিক উত্তোলনের জন্য নতুন পদ্ধতিগতভাবে উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। মিসরে ব্যবহƒত পলিথিন ব্যাগ এবং প্লাস্টিকের বর্জ্য থেকে তৈরি হচ্ছে টাইলস। ব্যতিক্রমী এ কাজের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখছে মিসরের একদল তরুণ উদ্যোক্তা। এর মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ এবং প্লাস্টিক বর্জ্যরে মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন তারা। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশেও ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে এ কার্যক্রম।
বাংলাদেশের উপকূল বা সৈকতে বেশি পাওয়া বর্জ্যরে মধ্যে প্রথমে আছে সিগারেটের ফিল্টার। তারপর খাবারের মোড়ক, পানীয় বোতল, বাসনকোসন, স্টাইরোফোম জাতীয় পণ্য। এগুলোর আরও শ্রেণিভাগ আছে তবে মোটা দাগে এভাবেই বলা যায়। যার সবকিছুই আমাদের ফেলে আসা। এই ফেলে আসার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে না এলে এর কোনো সমাধান নেই। কেননা, আমরা সামষ্টিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি আটকাতে পারব না। এ অগ্রগতি বা উন্নয়নের অনেক সুফল যেমন আছে কুফলও আছে। যাকে মোকাবিলা করতে হবে নিজেদের, নিজ দায়িত্বে। যে আকারের হোক, যেখানে হোক, যেভাবেই হোক; একটা প্লাস্টিকের মোড়ক, সিগারেটের ফিল্টার যদি তোলা হয় তবে তা সারা পৃথিবীর জন্য কল্যাণের। প্রতিদিন ১০ মিনিটের জন্য হলেও প্লাস্টিক বর্জ্য পরিষ্কার করতে পারি, যদি কেউ না আসে তো একাই করি। সাগরে যাওয়া ট্রলারের অনেক জেলেও বলছেন সাগর ও নদীতে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক বর্জ্য। তাদরে জালেও প্রতি ট্রিপে অনেক ৩০ থেকে ৪০ কেজির মতো। আমাদের বাংলাদেশে যে হারে দিন দিন প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে ভবিষ্যৎ নিশ্চিত অন্ধকার নেমে আসবে। এ থেকে উত্তরণের উপায় কি? প্লাস্টিকের উৎপাদন নিষিদ্ধ করা আছে। অথচ উৎপাদন বন্ধ হচ্ছে না, মানাও হচ্ছে না। নাগরিকদের বিকল্প এবং পরিবেশবান্ধব পণ্য উৎপাদন বা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, মাঠ পর্যায় প্রচার-প্রচারণা, উঠান বৈঠক করতে হবে। তরুণ প্রজš§কে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, যুবদের বেশি বেশি প্লাস্টিক বজ্য ব্যবহার থেকে বিরত এবং পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহারে আগ্রহী করতে হবে।
উপকূলে রয়েছে অনেক সম্পদ, পর্যটন, মৎস্য থেকে শুরু করে সমুদ্রে সুনীল অর্থনীতি রয়েছে। দেশটাকে টিকিয়ে রাখছে উপকূল, লাখো শ্রমিক, মৎস্যজীবী জিডিপিতে জোগান দিচ্ছে। তাই আমরাদের উচিত ঐক্যবদ্ধ হয়ে উপকূলকে রক্ষা করা, উপকূলকে পরিচ্ছন্ন রাখা।