জুনায়েদ আহম্মেদ, লক্ষীপুর: ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া সাকিব (ছদ্মনাম)। ৪ এপ্রিল ১৩ বছরের এই শিশুটির শরীরে বাহক হয়েই করোনাভাইরাস প্রথমবারের মতো লক্ষীপুরের রায়পুর উপজেলায় তার আগমনের বার্তা পৌঁছে দেয়। আক্রান্ত শিশুটি রায়পুর উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের রাখালিয়া গ্রামের বাসিন্দা।
আক্রান্ত হওয়ার আগের দিনও যে ছেলেটি বন্ধুদের সাথে দুরন্তপনায় ফুটবল খেলেছে মাঠে, গোসল করেছে পুকুরে, বাজারে গিয়েছে বাবার সাথে, রাত হতে না হতেই তার বাড়িটাকে করা হয় লকডাউন।

রাতের অন্ধকারেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আইসোলেশন কেবিনে। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের আইসোলেশনে নেয়ার পর শিশুটির মন আরো ভেঙ্গে পড়ে। করোনায় সচেতন করার পাশাপাশি আতঙ্ক দূর করার জন্য ওই শিশুকে হাসপাতালে দেখতে যান রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাবরীন চৌধুরী।
ছোট্ট এই শিশুটির কান্নাকাটির প্রেক্ষিতে তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনা করেই পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে আলাদা কক্ষ, বাথরুমের ব্যবস্থা করে স্বাস্থ্য বিভাগের তত্ত্বাবধানে ছেলেটিকে তার বাড়ি পৌঁছে দেন ইউএনও। এসময় শিশুটির বাড়িসহ আশেপাশের ৬টি বাড়ির ১৭টি পরিবারকে লকডাউন করা হয়। পুরো এলাকায় লাল পতাকা দিয়ে মসজিদে সতর্কতামূলক মাইকিং করা হয়।

করোনা মোকাবেলায় উৎসাহ প্রদানের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিশুটির কাছে পৌঁছে দেয়া হয় ‘স্নেহের আঁচল’ শিরোনামে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, টিস্যু, ডেটল সাবান, করোনা প্রতিরোধে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারের উপহার সামগ্রী ট্যাং, আদা, তরমুজ, আপেল, লেবু, কাঁচা আম ও মাল্টা।
এদিকে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য লক্ষীপুর জেলা লকডাউন করা হয়। অধিক নিরাপত্তার স্বার্থে বন্ধ করতে হয়েছে দোকানপাট, সীমিত করতে হয়েছে জনসমাগম। হাসপাতাল কিংবা বাড়ি, জন্ম কিংবা মৃত্যু সব জায়গায় সচেতনতায় থমকে গেছে কান্না এবং হাসি।

করোনা পরিস্থিতিতে অগ্রাধিকারভিত্তিতে, স্বজনপ্রীতিতে, সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে রায়পুর উপজেলায় কম-বেশি খাদ্য সহায়তা বেশিরভাগ ব্যক্তিই পেয়েছেন। কিন্তু নজরে আসেনি নবজাতক শিশু এবং পুষ্টিহীনতায় জর্জরিত অনেক মায়ের কান্না।
গর্ভবতী মা এবং সন্তান প্রসব পরবর্তী মা ও নবজাতকের যত্নে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে ব্যতিক্রমধর্মী মানবিক উদ্যোগ ‘স্নেহের আঁচল’ নিয়ে হাসপাতালে ছুটে যান ইউএনও শাবরীন চৌধুরী।
রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সদ্য জন্ম নেয়া ৫টি নবজাতক শিশু ও তাদের মায়েদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয় ‘স্নেহের আঁচল’। করোনা পরিস্থিতিতে মা এবং মায়ের কোল সুস্থ ও নিরাপদ রাখার উদ্দেশ্যে পাঠানো এই উপহার সামগ্রী। যার মধ্যে পুষ্টিকর খাদ্য ও ফলমূল ছাড়াও সাবান, মাক্স এবং নবজাতক শিশুর জন্য নতুন কাপড় রয়েছে।

স্থানীয়রা বলছেন, করোনা প্রার্দুভাবেব প্রথম থেকেই সচেতনতায় রাতদিন ছুটছেন ইউএনও। উপজেলা শহর থেকে শুরু করে অজোপাঁড়া গাঁও পর্যন্ত পড়েছে তার পদচিহ্ন। করোনা সনাক্ত হওয়ার পর এলাকাবাসী আক্রান্তদের একঘরে করতে চাইলেই এগিয়ে আসেন ইউএনও সাবরীন।
চিকিৎসার ব্যবস্থা করাসহ দেন ভরসা আর সাহস। বাড়িয়ে দেন ‘স্নেহের আঁচল’ নামে ভালোবাসার পরশ। এর মাধ্যমে মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করেন করোনাকে ভয় নয়, জয় করতে হয়। বহুমাত্রিক পদক্ষেপের ফলে করোনা সচেতনতায় পুরো জেলার মধ্যে রায়পুর অনেক এগিয়ে। শুধু লক্ষীপুর নয় সারা দেশের মধ্যে যেসব এলাকা সচেতনতায় এগিয়ে তার মধ্যে রায়পুর অন্যতম।

করোনায় সবচেয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় থাকেন গর্ভবতী নারীরা। খবর পেলে ছুটে যান হাসপাতালে। দেন সাহস। সাথে সদ্য ভুমিষ্ঠ হওয়া শিশুর যত্নে বাড়িয়ে দেন স্নেহের আঁচল। এছাড়া ৩৩৩ নাম্বারে ফোন দিলেও অসহায়দের দ্বারে পৌঁছে যান স্নেহের আঁচল। ইউএনও এর স্নেহের আচঁল ইতোমধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: জাকির হোসেন বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শিশুটির প্রতি মানবিক আচরণ করতে ইউএনও প্রতিনিদিই ওই রোগীর খোঁজ খবর নিচ্ছেন। স্থানীয়দের মানসিকতার পরিবর্তন, রোগীর প্রতি মমত্ববোধ, গর্ভবতী মা এবং সন্তান প্রসব পরবর্তী মা ও নবজাতকের যত্নে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এই উদ্যোগে নিয়েছেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরীন চৌধুরী বলেন, করোনা আক্রান্তরা যেন নিজেদের একা না ভাবেন, তারা যেন মানসিকভাবে চাঙ্গা থাকেন তাই এই প্রচেষ্টা। করোনাভাইরাসের আতঙ্ক যেন হতাশ করতে না পারে, সে জন্যই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই উদ্যোগ মা ও নবজাতকের মুখে হাসি ফোটাতে সহায়ক হবে।