নিজস্ব প্রতিবেদক: সকাল ৬টা ১০ মিনিট থেকে দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটÑপ্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টার আগুন। বঙ্গবাজার মার্কেট থেকে আগুনের সূত্রপাত। সেই মার্কেট পুড়ে ছাই। আগুন ছড়িয়ে পড়ে আরও চারটি মার্কেটে। ঈদ উপলক্ষে ছিল বাড়তি দোকানি। আগুনে শুধু দোকান আর দোকানের পণ্য পুড়েনি, পুড়ে গেছে এ পাঁচ হাজার দোকানির স্বপ্নও। পরে ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিট, বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী ও পুলিশের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। বঙ্গবাজারের এ অগ্নিকাণ্ড সাম্প্রতিককালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। তবে ফায়ার সার্ভিস সময়মতো আগুন নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা না করায় সব পুড়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, বঙ্গবাজার দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি কাপড়ের মার্কেট। ঈদ কেন্দ্র করে রোজা শুরুর পর থেকে ধীরে ধীরে জমে ওঠে এ মার্কেটের ব্যবসা। চলতি বছরও কেবল জমতে শুরু করেছিল বেচাকেনা। কিন্তু হঠাৎ লাগা আগুন সব কেড়ে নিল ব্যবসায়ীদের।
অপরদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশনের দাবি, মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ১০ বার নোটিশ দেয়ার পরও ব্যবসায়ীরা সতর্ক হয়নি। অগ্নিকাণ্ডে পাঁচ হাজার ব্যবসায়ীর দুই হাজার কোটি টাকার মালামাল পুড়ে গেছে। ঈদ সামনে রেখে পথে বসে যাওয়া এ ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনে সাতশ কোটি টাকার বরাদ্দ চেয়েছে দোকান মালিক সমিতি। ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারের পক্ষ থেকে ১৫ হাজার টাকা ও ১৪ কেজি করে খাদ্য দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের সূত্রমতে, সকাল ৬টা ১০ মিনিটে বঙ্গবাজারে আগুন লাগে। সকাল ৮টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের ৪১টি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। পরে ৫০টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করে। দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বঙ্গবাজারে আগুন লাগার পর সংলগ্ন অন্তত পাঁচটি মার্কেটে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নেভাতে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনীর সাহায্যকারী দল এসে যুক্ত হয়। এ আগুনে অনেক ব্যবসায়ীর দোকানের সর্বস্ব পুড়ে গেছে। অনেক ব্যবসায়ীর একাধিক দোকান ছিল, কোনোটি অক্ষত থাকেনি। আশপাশের মার্কেট থেকে কেউ কেউ তাদের মালামাল বের করে আনতে পেরেছিলেন। বঙ্গবাজার থেকে একপর্যায়ে আশপাশের একাধিক মার্কেটে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া পুলিশ সদর দপ্তরের ব্যারাকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। আগুনের ধোঁয়ায় ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন কর্মী আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, বিজিবি, আনসার সদস্যরা অংশ নেন।
অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়ন ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে আট সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ডিএসসিসি সচিব আকরামুজ্জামানের সই করা এক দপ্তর আদেশে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ ঘটনায় প্রায় ৫ হাজার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক দুই হাজার কোটি টাকার। এমন দাবি করে প্রাথমিকভাবে ৭০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ চেয়েছেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে তিনি বলেন, শুধু বঙ্গবাজার কাঠের মার্কেটেই আড়াই হাজারের মতো দোকান রয়েছে। এখানে ছোট ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দোকান করেন। সামনে ঈদ। সবাই ঈদকেন্দ্রিক বেচাকেনার পণ্য তুলেছেন দোকানে। এমন সময় এ অগ্নিকাণ্ড বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে এনেছে। ব্যবসায়ীদের পুঁজি বলতে দোকানের মালামালই। মালামাল পুড়ে গেলে তাদের আসলে পুঁজি বলতে সব শেষ। এখন তাদের জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, রমজানের ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসায় ক্ষতি পুষিয়ে দিতে প্রাথমিকভাবে সাতশ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেয়া হোক।
অগ্নিকাণ্ডের জন্য ফায়ার সার্ভিসের অবহেলাকে দায়ী করছেন মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, শুরুতে একে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। তাই দুটি আগুন নির্বাপক বোতল নিয়ে এসেছিলেন। পরে আগুন বাড়লে মার্কেটের চেয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার রক্ষার চেষ্টাই বেশি করেন বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীরা। বঙ্গবাজারে ভোর ৬টা ১০ মিনিটে অগ্নিকাণ্ড শুরু হয়। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ৬টা ১২ মিনিটে। অভিযোগ করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলেন, ৬টায় আগুন লাগলে তাদের ডাক দিলে তারা বোতল (আগুন নির্বাপক) নিয়ে আসেন আগুন নেভাতে। কিন্তু আগুন নেভেনি। তাদের বলা হয়েছে পানির গাড়ি নিয়ে আসতে। তারা বলে ওপর থেকে তাদের নির্দেশ আসেনি। হুকুম আসছে ৭টার পর। এরপর তারা পানি আনেন, সেটারও স্পিড নেই। সারাদেশের ফায়ার সার্ভিসের মেইন অফিস এখানে, আর এখানে বলে তাদের পাম্পে পানি নেই। ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, সকাল ৮টার দিকে তাদের পানি বাড়ানোর কথা বলা হলে কর্মীরা বলেছেন, বছরে দুই একবার আগুন লাগবেই। ঈদে আগুন লাগেই। শুরুতে এত ঘটনা ঘটতই না। যখন সকালে একটু আগুন ছিল, তখন ঠিকমতো পানি দিলে একটা দুটি দোকান পুড়ত। এ ঘটনায় দুই হাজার কোটি টাকার মালামাল পুড়ে গেছে। কয়েক হাজার ব্যবসায়ী সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। একই সঙ্গে ঈদের আগে এসব মার্কেটে কর্মরত অর্ধলাখ কর্মচারী বেকার হয়ে পড়ার এবং বেতন না পাওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন জানিয়েছেন, ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল বঙ্গবাজার মার্কেটটিকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর সংশ্লিষ্টদের ১০ বার নোটিশ দেয়া হয়। কিন্তু তারা কথা শোনেননি। দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর ঘটনাস্থলে করা এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান তিনি। তিনি বলেন, আমরা এ মার্কেটের সামনে এরকম ব্যানারও টাঙিয়েছিলাম ২০১৯ সালে। আপনারা মিডিয়া প্রতিনিধিরা অবশ্যই জানেন, এরকম ব্যানার আমরা টাঙিয়েছি, আপনারা দেখেছেন।
তিনি বলেন, ‘আজকের ঘটনায় সিভিলিয়ান কেউ এখনও হতাহত হয়েছে বলে আমার জানা নেই, কিন্তু ফায়ারের ৮ জন আহত আছে এবং দুজন ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে আছে বার্ন ইউনিটে। অন্যদিকে আগুন নেভাতে দেরি হওয়ায় বিক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা ফায়ার সার্ভিসের হেড কোয়ার্টারে ভাঙচুর করেছেন।’
আগুনে ছয়টি মার্কেটের প্রায় পাঁচ হাজার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহযোগিতা করবেন বলে জানান তিনি। গতকাল বিকালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা জানতে পেরেছি, ৫ হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঈদ উপলক্ষে তারা অনেক মালামাল ক্রয় করেছিল। সেগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। যদিও পুলিশ প্রশাসনের সদস্যদের চেষ্টায় অনেকে মালপত্র উদ্ধার করে সরিয়ে নিতে পেরেছে, তারপরও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের টিম কাজ করছে। যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তের পর আমরা জানতে পারব। প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তদন্ত করে ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করার পর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের জন্য তিনি কাজ করবেন। আর ডিসিকে আমরা আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দিয়েছি, হতাহতদের প্রত্যেককে পনেরো হাজার টাকা করে এখনই দেবেন। আহতদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। এ ঘটনাকে আমরা এখন পর্যন্ত দুর্ঘটনা বলেই বর্ণনা করব। তদন্ত রিপোর্ট আসা পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে কোনো মতামত দেয়া ঠিক হবে না। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সাড়ে ১৪ কেজি করে খাবার দেয়ার কথা জানান দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। তিনি জানান, এর মধ্যে থাকবে চাল, ডাল, তেল ও মসলা। এ আগুনের ক্ষতি নিরূপণ করে ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিদের পুনর্বাসনে যথাযথ সহায়তা দেয়া হবে।
ফায়ার সার্ভিসের একটি সূত্র জানিয়েছে, বঙ্গবাজারে আগুনের সূত্রপাত ওই এলাকার আদর্শ মার্কেট থেকে। পরে দ্রুতগতিতে পাশের মার্কেটগুলোর চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। গতকাল ভোর ৬টা ১০ মিনিটে ৯৯৯ থেকে তাদের কাছে ফোন করা হয়। জানানো হয়, বঙ্গবাজারে আদর্শ মার্কেটে আগুন লেগেছে। পরে কয়েক মিনিটের মধ্যে আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে ফায়ার সার্ভিস পৌঁছালে মার্কেটে প্রবেশ করতে বাধা ছিল। মার্কেটের চারদিকে যে তালাগুলো লাগানো ছিল সেগুলো ভাঙতে অসুবিধা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের। কারণ তালাগুলো ভেতরে ছিল।
ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে ব্যবসায়ীদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছে এফবিসিআই, ডিসিসিআইসহ বেশ কয়েকটি ব্যবসায়িক সংগঠন।