শেখ আবু তালেব: ঋণের বাজারে সর্বনিন্ম সুদহার হচ্ছে এখন ব্যাংক খাতে। সরকারও সুযোগটি কাজে লাগাতে শুরু করেছে। উচ্চ সুদের সঞ্চয়পত্রের ঋণ কমিয়ে ব্যাংকমুখী হচ্ছে। এ কারণে সাড়ে তিন মাসের ব্যবধানে সরকার ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে।
চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) সাড়ে তিন মাস সময়ে ব্যাংক খাত থেকে সরকার মোট ১৪ হাজার ৯৭২ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। ঋণের বেশিরভাগই নিয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে। এই অর্থ থেকে আবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের পাঁচ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। ফলে আলোচিত সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার নিট ঋণ নিয়েছে ৯ হাজার ১৮০ কোটি টাকা।
এদিকে গত ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারের ব্যাংক খাতে ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, মোট ঋণের এক লাখ ৯২ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকাই বাণিজ্যিক ব্যাংকের। অবশিষ্ট ১৮ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা নেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে।
প্রসঙ্গত, বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক ও জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। আর চলতি অর্থবছরের বাজেটে চলতি অর্থবছরের জন্য ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা।
গত অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উচ্চ সুদে জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিয়েছে সরকার। এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদহার কমিয়ে দিয়েছে। একইসঙ্গে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। ফলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমে গেছে আছে তুলনায়।
তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দুই হাজার ১০৪ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেছে জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর। গত বছরের এই সময়ে নিট বিক্রি ছিল তিন হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। যদিও চলতি অর্থবছরের গত দুই মাসের (আগস্ট-সেপ্টেম্বরের) তথ্য এখনও প্রকাশ করেনি সঞ্চয় অধিদপ্তর। গত জুলাই শেষে সঞ্চয়পত্রের মোট নিট বিক্রির পরিমাণ তিন লাখ ৪৬ হাজার ১৯৮ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এই বিশাল অঙ্কের টাকার সুদ বা মুনাফা গুনতে হবে এখন সরকারকে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরেছে সরকার।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, সঞ্চয়পত্র থেকে গত অর্থবছরে ৪২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল সরকার। কিন্তু মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার করার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় ৩ জুন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় সেই লক্ষ্য বাড়িয়ে ৩০ হাজার ৩০২ কোটি টাকা করা হয়।
কিন্তু বছর শেষে দেখা যায়, সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে মূল বাজেটের দ্বিগুণেরও বেশি ঋণ নিয়েছে। সংশোধিত বাজেটের চেয়ে বেশি নিয়েছে ৩২ শতাংশ। আর আগের অর্থবছরের চেয়ে বেশি নিয়েছে প্রায় তিনগুণ।
এবার সরকার ব্যাংকের দিকেই ঝুঁকছে। এর পেছনের কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই-আগস্টে ৩৪ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। গত অর্থবছরের আলোচিত সময়ে আদায় হয়েছিল ৩০ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করায় রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি। ফলে সরকারের অর্থের চাহিদাও এখনও শুরু হয়নি আগের মতো। এতে সরকারের অর্থের চাহিদা তুলনামূলকভাবে কম। মূলত অগ্রাধিকার হওয়ায় মেগা প্রকল্পগুলোতেই বরাদ্দ হওয়ায় অর্থের ছাড়করণ চলছে। এতে সামগ্রিকভাবে সরকারের ঋণচাহিদা এখনও সেভাবে তৈরি হয়নি।
গত অর্থবছরের আলোচিত সময়ে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল ৩৯ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা। কিন্তু এ অর্থবছরের নিয়েছে ১৪ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। নিট ঋণের পরিমাণ হয়েছে ৯ হাজার ১৮০ কোটি টাকা, কিন্তু গত অর্থবছরের এই সময়ে যা ছিল ৩২ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৬৫ শতাংশ কম ঋণ নিয়েছে।