নজরুল ইসলাম: ছিলেন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা। এখন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)। তার বিরুদ্ধে কক্সবাজারের দুটি প্রকল্পের সাড়ে ৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্প দুটি হলো কক্সবাজার পৌরসভার পানি শৌধনাগার ও পিবিআই প্রকল্প। তার নাম শামীম হুসাইন (পরিচিতি নম্বর-১৭৪৭৪)। তিনি ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট নীলফামালীর সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে যোগ দেন। তার আগে কক্সবাজার জেলায় ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা ছিলেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এ অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে।
কক্সবাজার জেলার তিনটি মেগা প্রকল্পে দুর্নীতির মামলার তদন্ত করতে গিয়ে তার সম্পৃক্ততা পায় দুদক। পৌরসভা পানি শোধনাগার প্রকল্পে তিনি অধিগ্রহণের জন্য কম মূল্যের জায়গাটি নির্বাচিত থাকা সত্ত্বেও স্থান পরিবর্তন করেছেন এবং সরকারি সম্পত্তি ও সিভিল মামলার নিষেধাজ্ঞা আছে জেনেও পেমেন্ট করেছেন। এখানে তিনি ৭ কোটি ১৪ লাখ ৮৮ হাজার ৭৮০ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। পিবিআই প্রকল্পে চন্দ্রিমা হাউজিংয়ের জাল দলিল ও খতিয়ানের কোনো জায়গা না থাকা সত্ত্বেও সে জায়গায়কে অধিগ্রহণের আইন ভঙ্গ করে অধিগ্রহণের আওতাধীন দেখিয়েছেন, বাতিল ও স্থগিত খতিয়ানকে আমলে নিয়েছেন, ৪ ধারা ও ৭ ধারা গোপন করে পেমেন্ট করেছেন। চেক গ্রহীতা মোহাম্মদ ইদ্রিছের কাছ থেকে তিনি এসএ পরিবহন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন।
গত ১ জুলাই ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ঘুষের ২৩ লাখ ৬৩ হাজার ৯০০ টাকাসহ আটক হন কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি হুকুম দখল কার্যালয়ের (এলএ) সার্ভেয়ার আতিকুর রহমান। তার বিরুদ্ধে গত ৪ জুলাই মামলা করে দুদক। ১৯ জুলাই তিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছেন। সেখানে তিনি দুজনের নাম বলেন। তার মধ্যে শামীম হুসাইনের সম্পৃক্ততার কথাও জানান। তার অধীনেই আতিকুর রহমান কাজ করতেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পৌরসভার পানি শৌধনাগার প্রকল্পে তিনি ৫২/৮৬ নম্বর মামলার ১৬৩ নম্বর বিবাদী। এছাড়া হাইকোর্টে রিট পিটিশন নম্বর ১৪৬৮১/২০১৯ এর বিবাদী। তিনি অধিগ্রহণ আইন অমান্য করেন। কক্সবাজার জেলার এলএ মামলা নম্বর ০৪/১৯-২০ এর ২০১৫ সালের ১৮ মে তারিখে প্রস্তাবিত বাঁকখালী নদীর উত্তরপাড়ের প্রস্তাবিত ভূমিটি স্থান পরিবর্তন করে বাঁকখালী নদীর দক্ষিণ পাড়ে দশগুণ বেশি মূল্যবান জমিতে প্রকল্পের জমি নির্ধারণ করেন। সরকারি টাকা অপচয়, কারচুপি ও আত্মসাতের উদ্দেশ্যে তিনি এটি করেছেন। স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন-২০১৭ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত নির্দেশনাবলীর ০৪ (ঘ) নম্বর অনুচ্ছেদ ভঙ্গ করে মেয়র মুজিবুর রহমানের স্ত্রী ফারহানা
আক্তার ও শ্যালক মিজানুর রহমানকে অধিগ্রহণ করা জমি ২.১৯ একরের মধ্যে ১.৭২ শতক জমি পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ১.১৯০০ একর জমির ওপর ০৩/১৯৮৮-৮৯ নম্বর র্রিসিভার মামলা ও অপর মামলা ৫২/১৯৮৬ বিচারাধীন থাকাবস্থায় সদর সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসের মোক্তারের যোগসাজশে সরকারি রিসিভার করা জমি ব্যক্তির নামে দখল দেখিয়ে জমি নামজারিকরণ, নোটশিটের আদেশের ক্রমিক নম্বর- ৬ অনুযায়ী ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর তারিখের রিসিভারি মামলা ও গোলাভাগের মামলা রয়েছে জেনেও তা নিষ্পত্তি করেননি। প্রত্যাশী সংস্থা নির্ধারণ না করেই মেয়র মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগসাজশে ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর তারিখে ৪ ধারা ও ২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর তারিখে ৭ ধারা এবং ১৭ ডিসেম্বর তারিখেই প্রাক্কলন প্রত্যাশী সংস্থার কাছে প্রেরণ করা, অপর মামলার (৫২/১৯৮৬) আদেশ (নম্বর-১৪৮, ৭/১/১৮) মূলে তাকে ১৬৩ নম্বর বিবাদী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা, হাইকোর্টে রিট পিটিশন নম্বর-১৪৬৮১/২০১৯ এর ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর এর আদেশকে মিসগাইড করে যথাযথভাবে নিষ্পত্তি না করেই মিজানুর রহমানকে ২০২০ সালের ৯ জুলাই তারিখে অধিগ্রহণের ৭ কোটি ১৪ লাখ ৮৮ হাজার ৭৮০ টাকা দিয়ে আত্মসাৎ করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি পিবিআই প্রকল্পের প্রত্যেকটি ক্ষতিপূরণের পেমেন্টকারী। প্রকল্পে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন, ২০১৭ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত নির্দেশাবলির নির্দেশিকা ১ ও ৪ অনুসরণ করেননি। ফিল্ড বুক প্রস্তুতকালীন সংশ্লিষ্ট কাউকে অবহিত না করা ও কারোরই স্বাক্ষর গ্রহণ না করার বিষয়টিও আমলে নেননি। অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ নুরুল হক কর্তৃক সবার পক্ষে কোনো রেকর্ড ছাড়াই প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েও এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে দাখিল করা তারিখবিহীন ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর তারিখের অবৈধ আবেদনটি আমলে নেয়া, দালিলিক রেকর্ড ও অবৈধ ফিল্ড বুক তথা তৈরি ফিল্ড বুক অনুযায়ী চেক প্রদান না করে ফাইল নোট ছাড়াই চন্দ্রিমাকে ক্ষতিগ্রস্ত দেখিয়ে ৪ ধারা হওয়ার পরে পাওয়ার গ্রহীতাদের পুনরায় রোয়েদাদভুক্ত করেন। ৪ ধারা ও ৭ ধারা গোপন করে চন্দ্রিমা হাউজিংয়ের জায়গাকে অধিগ্রহণের অংশে দেখিয়েছেন।
২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি তারিখের জননিরাপত্তা বিভাগের স্মারক নম্বর-৪৪.০০.০০০০.০৯৮.০৭.০১৬-১৭-১৩ অনুযায়ী আরএস ১৯৫০ নম্বর খতিয়ানে দাগ নম্বর ৮০০৪/৮৯২১ সুনির্দিষ্ট করা থাকলেও তিনি, জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন, এডিসি আশরাফুল আফসার একে অপরের যোগসাজশে চন্দ্রিমার ভুয়া পাওয়ার দলিলে ওই দাগ ও খতিয়ান অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ দিয়ে টাকা উত্তোলন, অধিগ্রহণের আইনের ৪ ধারার পরে পণমূল্য ছাড়া অধিগ্রহণের শর্ত সংযুক্ত করে অধিগ্রহণের আইনের ৪ ধারার পরে জাল আমমোক্তারগুলোতে আরএস ১৯৫০ নম্বর খতিয়ানে দাগ নম্বর ৮০০৪/৮৯২১ সন্নিবেশিত করে স্থগিত ও বাতিল খতিয়ানগুলোকে ঠিক হিসেবে ধরেন। যুগ্ম জেলা জজ আদালতে বিভিন্ন মামলা থাকাবস্থায় ও কক্সবাজারের সদর সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের অপর মামলার (নম্বর-২৫১/২০১৯) ২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর তারিখের আদেশ নম্বর-০৩ এর স্থিতাবস্থার আদেশ না মেনে চন্দ্রিমা হাউজিংয়ের জায়গাকে অধিগ্রহণের অংশে দেখিয়ে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা অজিত দেবের ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর তারিখে অধিগ্রহণভুক্ত জায়গায় মামলা রয়েছে মর্মে টাকা প্রদান করেন। স্থগিতাদেশ আদেশ অমান্য করে চন্দ্রিমা বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের অবৈধ দলিল ও জাল খতিয়ান খাঁটি হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে ওই খতিয়ান ও দলিল মূলে ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদান করেন। গ্রহীতাদের জমির মালিকানা দেখিয়ে রোয়েদাদভুক্ত করে ৪ ধারা ও ৭ ধারা গোপন করার বিষয়টি জেনেও গোপন করা, অসৎ উদ্দেশ্যে নাজিম উদ্দিনের দরখাস্ত দুইটি গায়েব করে পেমেন্ট থেকে বঞ্চিত করে তার টাকা জাল জালিয়াতির আশ্রয়ে অন্যকে দিয়ে আত্মসাৎ করেন। জাল অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি (পণমূল্য প্রযোজ্য নয়) নম্বর-১০৫০/২০২০ মূলে দরখান্ত নম্বর-০৭/২০২০, ০৮/২০২০ মাধ্যমে পেমেন্ট করেন। অথচ একই এলএও ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বর তারিখে অধিগ্রহণের এলাইনমেন্টভুক্ত নয় মর্মে পেমেন্ট না করা, আবার ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তারিখে আগের সিদ্ধান্তের বিপরীতে ক্ষতিপূরণের পেমেন্ট করা এবং অবৈধ উপায়ে তার দালাল আবু মোর্শেদ শাহজাহান, আশরাফ, অ্যাডভোকেট নুরুল হক, মোহাম্মদ ইদ্রিছের মাধ্যমে নিজে লাভবান হন এবং অন্যকে অন্যায় লাভে লাভবান করেন। চেক গ্রহীতা মোহাম্মদ ইদ্রিছ থেকে এস এ পরিবহন কুরিয়ার সার্ভিসের মারফত ২০১৯ সালের ২ ডিসম্বের তারিখে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ বা কমিশন গ্রহণ করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শামীম হুসাইন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি এরকম কোনো বিষয় জানি না। আমার কোনো মন্তব্য নেই।’
সৈয়দপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোখছেদুল মোমিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইউএনও রসিক মানুষ। তবে কোনো অনিয়মের খবর আমি জানি না। তিনি এখানে আসার আগে কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা ছিলেন।’