Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 12:16 am

সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অবাস্তব

নিজস্ব প্রতিবেদক: সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবতানির্ভর নয়। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ৫ থেকে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধিই অনেক বেশি। সেখানে বলে দেয়া হলো সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। এটা সামষ্টিক অর্থনৈতিক বাস্তবতা এই লক্ষ্যমাত্রাকে সমর্থন করে না। বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যে কোনো দেশই এই নিশ্চয়তা দিতে পারে না। বাংলাদেশ সেখানেই অবস্থান করছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত প্রাক-বাজেট আলোচনায় এমন মন্তব্য করেন সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান ড. জাঈদী সাত্তারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে কি-নোট উপস্থাপন করেন পিআরআই স্টাডি সেন্টার অন ডমেস্টিক রিসোর্স মোবিলাইজেশন প্রকল্পের পরিচালক ড. এমএ রাজ্জাক।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটের আকার হতে পারে ৭ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হতে পারে ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরকেই জোগান দিতে হবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এমন প্রাক্কলন করে নতুন বাজেট আসছে। রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রায় অর্ধলাখ কোটি টাকারও বেশি ঘাটতি থাকবে বলে ধারণা করছে পিআরআই।

তারা বলছেন, বর্তমান এনবিআর দিয়ে রাজস্ব বাড়ানো অবাস্তব। অর্থনীতিতে নেতৃত্ব সংকট রয়েছে। আগামী বাজেটে ৫ দফা সুপারিশ করেছে পিআরআই। বলছে, নির্বাচনের বছরে অর্থনীতিতে চাপ বাড়বে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরতে বিশেষ সুযোগ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোনো টাকাই দেশে ফেরত আসেনি। স্বার্থান্বেষী মহল কেউ কেউ এ সুবিধা নেবে। কিন্তু নৈতিকভাবে এটা সঠিক নয়। এতে সরকার বদনামের ভাগীদার হবে, কিন্তু উপকারে আসবে না। এটি সরকারের অবিবেচনাপ্রসূত ও ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এ সুযোগ যদি প্রত্যাহার করা হয়, তাহলে আমরা সরকারকে সাধুবাদ জানানো।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গত ১৫ মাস ধরে একটি সমস্যা রয়েছে এবং তা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এটা যত দীর্ঘায়িত হয়, সমস্যা বড় হয়; ক্ষত ততটা বাড়তে থাকবে। সাধারণ মানুষের ওপর দীর্ঘস্থায়ী বোঝা চাপতে থাকবে এবং তা বড় হতে থাকবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সরকার একটা শক্তিশালী অর্থনৈতিক টিম গঠন করবে, যেটার মাধ্যমে নীতিগুলো সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে।

আহসান এইচ মনসুর তার সুপারিশে বলেন, সরকার যেটা এখন পর্যন্ত করেছে, তা খুবই ক্ষুদ্র; বড় কোনো সংস্কার হয়নি। বড় উদ্যোগের মধ্যে ছিল মুদ্রার বিনিময় হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ

 কমিয়ে আনা। সরকার এখনও সুদহার নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রেখেছে। মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় এখনও কোনো নীতি প্রণয়ন করা হয়নি। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে এখন পর্যন্ত যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, তাতে রিজার্ভের পতন বন্ধ হয়নি; এটা চলছেই। গত ৯ মাসে ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামী ৮-৯ মাসে যদি আরও ৮-৯ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে হারায়, তাহলে আমরা কোথায় থাকব?

তিনি বলেন, রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় সরকারের নীতি কাজ করছে না। যদি কাজ না করে তাহলে নীতির পরিবর্তন করতে হবে। সরকারের নীতি হওয়া উচিত, আমরা আর রিজার্ভ বিক্রি করব না, প্রত্যেকে মার্কেটে যাও। তাহলে মার্কেটে মুদ্রার বিনিময় হারের ওপর চাপ তৈরি হবে। আস্তে আস্তে স্থিতিশীলতা আসবে। আর সরকার বিদেশ থেকে যে ধার করে নিয়ে আসবে, সেটা রিজার্ভে জমা হবে এবং রিজার্ভ বাড়বে।

তিনি বলেন, রিজার্ভ সাশ্রয়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। ফলে কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে। এতে উৎপাদন ব্যাহত হবে। ঝুঁকিতে পড়বে প্রবৃদ্ধি।

অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট বাস্তবায়নে দক্ষ না, কিন্তু নিয়ন্ত্রণে সার্থক বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, তারা বাজেট কমিয়ে দেবে। বাজেটের খরচ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ খুবই শক্তিশালী। অন্তত ২০টি দেশে কাজ করেছি। এসব দেশকে এত কার্যকরভাবে বাজেট ব্যয় ব্যবস্থাপনা করতে দেখিনি।

বাংলাদেশে কর্মরত বহুজাতিক কোম্পানি অডিট করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের অডিট প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়ার পরামর্শ দেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অ্যাকাউন্টিং ও অডিটের ধরন আন্তর্জাতিক মানের হয়। মানহীন অডিট ফার্ম দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান অডিট করানো হলে এবং সেখানে নেতিবাচক কিছু বের হলে তাতে দেশের সুনাম ক্ষুণœ হবে।

ড. জাঈদী সাত্তার বলেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলোয় চাপের আভাস থাকলেও বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের ৫০ বছরের পরিক্রমায় আজকে যে অবস্থানে আমরা আছি, তা একটি ইতিবাচক চিত্র। বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ির প্রসঙ্গে নেই; এটি অগ্রগতি ও উৎসাহব্যঞ্জক কতকগুলো সাফল্যের গল্পের সমাহার।

জাঈদী সাত্তার আরও বলেন, এখন আমরা শুধুই সামনে যাচ্ছি। বাজেট ব্যবস্থাপনায় এক অসাধারণ কাজ করছে বাংলাদেশ। সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অসাধারণ সাফল্য অর্জন করছে। এটা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকও স্বীকার করেছে। গত ২০ থেকে ২৫ বছরে আমরা সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ভালো করেছি। বৈদেশিক বাণিজ্যে যদিও ঘাটতি রয়েছে।

বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে নেতিবাচক সূচক সামনে এসেছে, বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি হচ্ছে। এগুলো হয়েছে সময়োপযোগী ব্যবস্থা না দেয়ার কারণে, এমন নয়। বরং সরকার বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছেÑবলেন জায়েদি সাত্তার।

তিনি বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে ৩৩ বিলিয়ন ডলার ট্রেড ঘাটতি হলো। আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হলো। যদিও পদ্ধতিটা ঠিক ছিল না, তারপরও এ উদ্যোগ ফল দিয়েছে।

আইএমএফের ঋণ গ্রহণ প্রক্রিয়ার শুরু থেকে বলা হচ্ছে শর্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ ঋণ পাচ্ছে। কিন্তু এখানে শর্তের কোনো বিষয় নেই বলে জানান জাঈদী সাত্তার। তিনি বলেন, শর্তের বিষয়টি গণমাধ্যমের সৃষ্টি। প্রকৃত বিষয় হলো, সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া; সরকার কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আর প্রতিশ্রুতি পূরণ না হলে ঋণ দেয়া হবে না, এটাও ঠিক নয়।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষপূরণ হবে না বলে জানান ড. এম এ রাজ্জাক। তিনি বলেন, রাজস্ব আদায়, প্রবাসী আয়, রপ্তানি আয় বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চায়ন চাপে রয়েছে। এই ঘাটতির ওপর আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রাক্কলন করা হবে।