সৈয়দ মহিউদ্দীন হাশেমী, সাতক্ষীরা: উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার মাটিতে লবণাক্ততার বৃদ্ধি ও জলাবদ্ধতার কারণে দিন দিন আবাদযোগ্য জমি হ্রাস পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের ফলে নদী খালের নাব্য হারিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। নিচু জমিতে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করার ফলে ৫০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে বোরো আবাদে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ফলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেখা দিয়েছে সংশয়। এরই মধ্যে কৃষক বীজতলা তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছেন। কোথাও কোথাও সেচযন্ত্রের মাধ্যম পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে আবাদের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় এক লাখ ৩১ হাজার ৭৮৮ হেক্টর। চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরায় ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে জলাবদ্ধতার কারণে ৫৫ হাজার ৭৮৮ হেক্টর জমিতে এবার বোরো চাষ অনিশ্চিত।
স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগÑখাল, বিল ও নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করার কারণে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। জেলার সব বড় বিল ও গ্রামের পানি নিষ্কাশনের মাধ্যম হলো কপোতাক্ষ, বেতনা, মরিচ্চাপ, খোলপেটুয়া ও সীমান্তের ইছামতী নদী। এসব নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে গেছে। ফলে প্রতি বছর বিলগুলোয় জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে। এতে করে বছরের ৯ মাস জলাবদ্ধতায় থাকে এ অঞ্চলের বেশিরভাগ কৃষিজমি, ফলে ক্রমান্বয়ে বোরো আবাদ কমতে শুরু করছে। তার ওপর উপকূলের বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবনের শঙ্কা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সঙ্গে উপকূলের যেমন তাপমাত্রা বেড়েছে, একই সঙ্গে বেড়েছে বন্যা, খরা, সাইক্লোন ও জলাবদ্ধতা। নদীর নাব্য সংকটের কারণে জোয়ারের লোনা জলের বিস্তৃতি ও তীব্রতা দুটোই বেড়েছে। ফলে উপকূলের কৃষিতে এর নেতিবাচক প্রভাব দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সদরের কুশখালি গ্রামের কৃষক আবদুল মান্নান বলেন, প্রাকৃতিক জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি মানুষ অপরিকল্পিতভাবে খাল, বিল ও নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করার কারণে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। জলাবদ্ধতার কারণে রবি মৌসুমে ধান, আলু ও শীতকালীন সবজিসহ বিভিন্ন ফসল চাষে আবাদি জমির স্বল্পতার কারণে হ্রাস পাচ্ছে রবিশস্য উৎপাদন।
তবে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিতে এত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) উদ্ভাবিত লবণসহিষ্ণু জাতের ধান এ অঞ্চলের কৃষকদের উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করেছে। জেলার বিভিন্ন ফসলি জমিতে আট থেকে ১৪ টিডিএস মাত্রার লবণাক্ততার উপস্থিতির ফলে যেসব জমিতে সাধারণ জাতের ধানবীজ চাষ করা প্রায় অসম্ভব, সেসব জমিতেও বিনা-১০, ৬৭ ও ৪৭ জাতের ধান আবাদ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
বিগত মৌসুমে কৃষকরা এসব জাতের আবাদ করে ভালো ফলন পেয়েছেন। তাই জেলায় লবণাক্ততা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লবণসহিষ্ণু ধানের আবাদও বাড়ছে।
কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তবে পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। যেমন বৈরী জলবায়ুর (লবণাক্ততা, বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা ও অধিক তাপসহিষ্ণুতা) সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো উচ্চফলনশীল ফসলের নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবন করা হচ্ছে। এগুলোর ব্যবহার ও চাষাবাদ বাড়াতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সরকার।
সাতক্ষীরা কৃষি বিভাগের উপপরিচালক নূরুল ইসলাম বলেন, চলতি মৌসুমে জেলায় ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে জলাবদ্ধতা না থাকলে বোরোর আবাদ আরও বেশি হতো।