Print Date & Time : 24 June 2025 Tuesday 2:48 am

সাত কারণে ১৩ জুন পাহাড়ধস

ইসমাইল আলী: ১৩ জুন চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও বান্দরবানে বড় ধরনের পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। এতে ১৬২ জনের প্রাণহানি হয়। প্রায় পাঁচ হাজার বাড়িঘর ধ্বংস হয়। সে সময় অতিবৃষ্টিতে এ ধসের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে সে দুর্ঘটনার পেছনে আরও কিছু কারণ ছিল, যা ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের সমীক্ষায় উঠে এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল পাহাড়ের ঢালু ছিল ঝুঁকিসীমার ওপরে।

সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। এতে পাহাড়ধসের সাতটি কারণ চিহ্নিত করা হয়। পাশাপাশি পাহাড়ধস প্রতিরোধ ও জননিরাপত্তায় কয়েকটি সুপারিশও তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী ভূমিধস বাড়ছে। নগরায়ণ বৃদ্ধি, বনাঞ্চল ধ্বংস ও জলবায়ু পরিবর্তন এর মূল কারণ। বাংলাদেশেও প্রায় প্রতিবছর এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তবে ১৩ জুন বড় ধরনের পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। সেদিন রাঙামাটির পাঁচটি উপজেলা (সদর, কাপ্তাই, বিলাইছড়ি, ঝুরাইছড়ি ও কাউখালী), চট্টগ্রামের দুটি (রাঙ্গুনিয়া ও চন্দনাইশ) এবং বান্দরবানের সদর উপজেলা আক্রান্ত হয়। এতে ১৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে ও প্রায় পাঁচ হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎ বিপর্যয় ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

ওই দিন এক হাজার বার ভূমিধস ঘটে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কে ১৫০ বার ধসের ঘটনা ঘটে। এতে এক সপ্তাহ ওই সড়ক বিচ্ছিন্ন ছিল। ২১ জুন হালকা যানের জন্য কাঁচা সড়কটি খুলে দেওয়া হয়। বেইলি সেতু পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। তবে পাকা সড়ক এখনও নির্মাণ হয়নি।

পাহাড়ধসের জন্য সাতটি কারণ চিহ্নিত করেছে ভ‚তাত্তি¡ক জরিপ অধিদফতর। এর মধ্যে অন্যতম হলো পাহাড়ের ঢালু ৩০ ডিগ্রির বেশি, যা ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া ওই দিন ভারী বর্ষণ হয়েছিল ওই এলাকায়, যা দুর্ঘটনার আরেকটি প্রধান কারণ। ১৩ জুন ২৪ ঘণ্টায় ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল তিন পাহাড়ি জেলায়। এতে পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে যায়। ফলে পাহাড়ের টারসিয়ারি ভূতাত্ত্বিক গঠনে পরিবর্তন আসে। এছাড়া পাহাড়ের আগের সৃষ্ট হওয়ায় ফাটল ছিল অন্যতম কারণ। এছাড়া সরু উপত্যকা এলাকা, পাহাড়ের ঢালুর পরিবর্তন, পাহাড় কাটা ও বন উজাড় ছিল ১৩ জুন পাহাড়ধসের অন্যতম কারণ।

প্রতিবেদনে ধসে পড়া পাহাড়ের কিছু অংশের বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, রাঙামাটি সদর এলাকায় ভূমিধসের অন্যতম কারণ ছিল পাহাড়ের ঢালু, যা ছিল ৫৪ ডিগ্রি। সেখানে তিন দশমিক ২০ মিটার গভীর ফাটল সৃষ্টি হয় পাহাড়ে। এ খণ্ডটির আয়তন ছিল ১৩ মিটার ও প্রস্থ ৩২ মিটার। সে খণ্ড ছড়িয়ে পড়ে ৮২ মিটার এলাকাজুড়ে। এতে মানিকছড়িতে ছয়জনের মৃত্যু হয়। আর ভেদভেদি বাজার এলাকায় পাহাড়ের ঢালু ছিল ৩৫ ডিগ্রি। সেখানে পাহাড়ে তিন দশমিক ৮০ মিটার গভীর ফাটল সৃষ্টি হয়। এতে মারা যায় ১০ জন।

রাঙামাটির ঘাগড়া ইউনিয়নে গিলাচরি মিয়ানগর এলাকায় দুজন মারা যায়। সেদিন চার দশমিক ৩০ মিটার গভীর ফাটল সৃষ্টি হয়। সে এলাকায় পাহাড়ের ঢালু ছিল ৩৪ ডিগ্রি। আর ঘাগড়া বাজার এলাকায় পাহাড়ের ঢালু ছিল ৪০ ডিগ্রি। সেখানে ফাটলের গভীরতা ছিল দুই দশমিক ৭০ মিটার। কাপ্তাই লক গেটের নতুন বাজার এলাকায় পাহাড়ের ঢালু ছিল ৪৪ ডিগ্রি ও চট্টগ্রামের বোগাবিলি এলাকায় পাহাড়ের ঢালু ছিল ৪৩ ডিগ্রি। এ দুই এলাকায় ফাটলের গভীরতা ছিল যথাক্রমে এক দশমিক ১০ ও তিন দশমিক ১০ মিটার। আর এতে মারা যায় পাঁচজন।

পাহাড়ধস প্রতিরোধে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, পাহাড়ি এলাকায় অনিয়ন্ত্রিত ও অগোছালো বসতি নির্মাণ, স্থানীয়ভাবে ভূমিধসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অংশ চিহ্নিত না করা, পাহাড়ি এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার জন্য ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনার অনুপস্থিতি, ভূমিধসের আগে ও পরের জন্য জরুরি সেবা প্রদানের জন্য যথাযথ সংস্থা তৈরি রাখা এবং জনগণের সচেতনতার অভাব।

এসব ঝুঁকি বিবেচনায় পাহাড়ধস নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর। এগুলো হলো ভূমিধসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা, এসব এলাকায় জনবসতি গড়ে তোলা বন্ধ করা, এ ধরনের এলাকায় যথাযথ প্রকৌশলগত ব্যবস্থা গ্রহণ, বর্ষাকালে সরু উপত্যকা পরিহার করে চলা, পাহাড়ের ঢালু ৩০ ডিগ্রির বেশি না রাখা ও জনসচেনতা সৃষ্টি অন্যতম।