সাত ধাপের খৈয়াছড়া

সিলেট ও চট্টগ্রামে বেশ কিছু অপূর্ব ঝরনা রয়েছে। দীর্ঘদিন এগুলোর বেশিরভাগের কথা স্থানীয়রা ছাড়া বাইরের কেউ জানতেন না। গত কয়েক বছরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়দের কল্যাণে এসব ঝরনা এখন পরিচিত তো বটেই, পর্যটকরাও ভিড় করছেন। এমনি একটি ঝরনা ‘খৈয়াছড়া’। চট্টগ্রাম শহরের কাছে পাহাড় ও জঙ্গলের অপূর্ব সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা পরিবেশে এই ঝরনার অবস্থান।

দুর্গম পাহাড় আর জঙ্গলের মাঝে যেন লুকিয়ে ছিল অপূর্ব স্থানটি। খৈয়াছড়ার বৈশিষ্ট্য হলো অন্য ঝরনার মতো এটি সরাসরি ওপর থেকে নিচে এসে পড়েনি। ঝরনাটির মোট সাতটি (কারও মতে ৯টি) ধাপ আছে। এর মধ্যে নিচ থেকেই দেখা যায় তিনটি ধাপ, ওপরের চারটি ধাপ দেখতে হলে বাঁ পাশের প্রায় খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে আরও শখানেক ফুট ওপরে। ওপরের সৌন্দর্যের তুলনায় এটা কিছুই নয়। ওপরে উঠলে দেখা মিলবে আরও একটি ধাপের। এর বাঁ পাশ দিয়ে সামান্য হাঁটলেই দেখা মিলবে অপর তিনটি ধাপের। এতেও যদি আপনার মন না ভরে তাহলে এই তিনটি ধাপের পাশ দিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠে যান আরও ওপরে। সেখানে আশপাশের বহুদূর বিস্তৃত পাহাড় আর জঙ্গলের অপূর্ব দৃশ্য কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেবে পরিশ্রম আর নিরাপদে নিচে ফিরে যাওয়ার নিশ্চয়তা।

বাংলাদেশে এমন ঝরনা দ্বিতীয়টি আছে কি না সন্দেহ, তবে তা তো পরের কথা। ঝরনায় যাওয়ার রাস্তাটিও কম মনোমুগ্ধকর নয়। বড় তাকিয়া বাজার ছাড়িয়ে যখন হাঁটা শুরু করবেন, শুরুতে রাস্তা সমতলই থাকবে। অদূরে চোখে পড়বে জঙ্গলে ঢাকা বিশাল পাহাড়। যা হোক, কিছুক্ষণ হাঁটলে রাস্তা

উঁচু-নিচু হতে থাকবে। এভাবে একসময় এসে পড়বেন পাহাড়ি ঝিরিপথে। এরপর শুরু হবে আসল অ্যাডভেঞ্চার। এখানে কোনো রাস্তা নেই, ঝিরি ধরেই হাঁটতে হবে। কখনো হাঁটুপানিতে পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটবেন তো সেই পানিই কখনও কখনও কোমর ছাড়িয়ে বুক পর্যন্ত উঠে আসবে।

মাঝেমধ্যে ঝিরি ছেড়ে পাশের টিলায় উঠতে পারবেন। চারপাশের জঙ্গল দেখে মনে হবে মানববসতি ছেড়ে কোনো এক দুর্গম জায়গাতেই না এসে পড়েছেন। এভাবেই হাঁটতে হবে প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো। আপনার চলার গতির ওপর নির্ভর করবে কতক্ষণে পৌঁছাবেন গন্তব্যে। পথে বেশ কয়েকবার দেখবেন পানি ঝরনার মতো ছড়িয়ে পড়ছে, তবে এতে আহ্লাদিত হওয়ার কিছু নেইÑআসল চমক সামনে অপেক্ষা করছে।

ঝরনার কাছে পৌঁছানোর আগেই ঝমঝম শব্দে পানি পড়ার শব্দে বুঝে যাবেন গন্তব্যের কাছাকাছি চলে এসেছেন। তারপর যখন গাছপালার আড়াল থেকে খৈয়াছড়ার দর্শন পাবেন, তখন বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়বেন নিশ্চিত। অনেক উঁচু থেকে প্রবল শব্দে নিচের পাথরের ওপর আছড়ে পড়া পানি দেখে গোসলের লোভ সামলানো বেশ কঠিন হবে তখন। নেমে পড়–ন বরফশীতল ঠাণ্ডা জলে। ডুবে যাওয়ার ভয় নেই, পানি কখনই আপনার বুক ছাড়াবে না, কাজেই সাঁতার না জানলেও সমস্যা নেই। তবে সাবধান থাকা ভালো। ঝরনার ডানদিকটা অপেক্ষাকৃত গভীর।

পাখিপ্রেমীদেরও এই ঝরনা নিরাশ করবে না। ঝরনায় যাওয়ার পথের দুই পাশে দেখা মিলবে ঘুঘু, টিয়া, কাঠঠোকরাসহ হরেক রকম পাখির। তবে এরই মধ্যে পথের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল পরিষ্কার করে সেখানে লাগানো হয়েছে নানা অর্থকরী গাছ, যা কিছুটা হলেও ক্ষুণœ করেছে এখানকার সৌন্দর্য।

 

যেভাবে যাবেন

রাজধানীর যে কোনো বাস কাউন্টার থেকে চট্টগ্রামগামী বাসে উঠে পড়লেই হবে। ভাড়া পড়বে ৪৮০ টাকা। পথে যানজট না থাকলে সাত ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন বন্দরনগরীতে। এখান থেকে গাড়ি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা অথবা বাসে যেতে হবে মিরসরাই উপজেলার বড় তাকিয়া বাজারে। এক্ষেত্রে সময় আর ভাড়া বিবেচনা করলে বাসই সবচেয়ে পছন্দের বাহন। বাসে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৫০ টাকা। বেশি লোক থাকলে গাড়ি ভাড়া করতে পারেন, অথবা যেতে পারেন অটোরিকশায় চড়ে। এক্ষেত্রে ভাড়া দরদাম করতে হবে।

বড় তাকিয়া বাজারে খৈয়াছড়া আইডিয়াল স্কুলের কাছে গিয়ে স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলে দেবে কোন পথে যেতে হবে। চাইলে গাইডও নিতে পারেন, তবে নিজেরা গেলেই রোমাঞ্চের স্বাদ বেশি পাওয়া যাবে। ঝরনায় যাওয়ার রাস্তা একটিই, আর পথে আরও অনেক অ্যাডভেঞ্চারপিয়াসীর দেখা পাবেন, কাজেই পথ হারানোর ভয় নেই বললে চলে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পাহাড়ি ঝিরিপথ ধরে এক থেকে দেড় ঘণ্টা হাঁটলে দেখা পাবেন ঝরনার। হাতে সময় নিয়ে যাওয়া ভালো, ঝরনা দেখে ফিরতে ফিরতে বেশ সময় লাগবে। খাবার সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারেন, তবে ঝরনায় যাওয়ার পথেই অন্তত তিনটি জায়গায় দেখা মিলবে স্থানীয় হোটেলের। খাবারের দাম তুলনামূলকভাবে সস্তা।

 

মনে রাখবেন

চিপসের প্যাকেট, সিগারেটের ফিল্টার, পানির বোতলসহ অন্য আবর্জনা যেখানে-সেখানে ফেলবেন না। আবর্জনা ফেলার জন্য পথে ডাস্টবিন পাবেন। পথে জোঁক থাকতে পারে, সতর্ক থাকবেন। লবণ সঙ্গে রাখলে ভালো। জোঁকে কামড়ালে হাত দিয়ে টেনে ছাড়াতে যাবেন না, লবণ ছিটিয়ে দিলেই হবে। সিগারেটের তামাকও ব্যবহার করতে পারেন।

ঝরনায় যাওয়ার রাস্তা বেশ দুর্গম। শিশু, বয়স্কদের নিয়ে কোনোভাবেই যাওয়া উচিত নয়। বড়রাও যথেষ্ট সতর্ক থাকবেন। মারাত্মক কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ওই দুর্গম রাস্তা পাড়ি দিয়ে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব। সাত ধাপের এই ঝরনার পাশের খাড়া পাহাড় দিয়ে একদম ওপরে ওঠা যায়। তবে এই পথ অত্যন্ত দুর্গম ও বিপজ্জনক। পা ফসকে নিচে পড়লে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কাজেই পাহাড়ে চড়ার অভিজ্ঞতা না থাকলে ওপরে ওঠার চেষ্টা না করাই ভালো।

ঝরনায় যাওয়ার রাস্তায় অতিরিক্ত হইচই না করাই ভালো। প্রাকৃতিক পরিবেশে বিকট শব্দ করার চেয়ে চুপচাপ এর সৌন্দর্য উপভোগ করাই সচেতন পর্যটকের নমুনা। এমন জুতা আর কাপড় পরবেন, যা ভিজলেও স্বচ্ছন্দে হাঁটতে পারেন।

 

রবিউল কমল

 

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০