Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 6:54 pm

সাত ব্যাংককে ২২ হাজার কোটি টাকার বিশেষ ধার

রোহান রাজিব: সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত বিভিন্ন পন্থায় জামানত নিয়ে ধার দিয়ে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে চরম সংকটে থাকা সাতটি ব্যাংকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরভিত্তিক আর্থিক প্রতিবেদন (ব্যালেন্স শিট) ভালো দেখাতে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার বিশেষ ধার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তিন দিনের জন্য দেয়া এ ধারের জন্য রাখা হয়নি কোনো সিকিউরিটি বা জামানত। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত হয় ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে। আর্থিক প্রতিবেদনে যেন বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণ করতে না পারা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে রক্ষিত চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখাতে না হয়, সেজন্য বিশেষ ধার দেয়া হয়েছে। সাধারণত কোনো ব্যাংক নগদ টাকার সংকটে পড়লে আগে বিনিয়োগ করা ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে ধার নেয়। তবে সাতটি ব্যাংকের পর্যাপ্ত সিকিউরিটি না থাকায় বিশেষ ‘প্রমিসারি ডিমান্ড নোট’-এর বিপরীতে তিন দিন মেয়াদে ধার দেয়া হয়েছে। ব্যাংক হলিডের কারণে গতকাল শেষ কর্মদিবসে লেনদেন বন্ধ থাকে, যে কারণে গত ২৮ ডিসেম্বর ওই ধার দেয়া হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ। ব্যাংকগুলো তাদের প্রয়োজন অনুসারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেয় এবং ফেরত দেয়। সেই প্রক্রিয়া আমরা অব্যাহত রেখেছি এবং ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।

ব্যালেন্স শিট ভালো দেখাতে ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দেয়া হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র বলেন, ব্যালেন্স শিট ভালো দেখাতে টাকা ধার দেয়া হয়েছে, এমনটি নয়। আমরা কারও প্রয়োজন হলে টাকা ধার দিই এবং নির্দিষ্ট সময় পর ব্যাংকগুলো তা ফেরত দিয়ে থাকে। কোন ব্যাংককে কী পরিমাণ টাকা ধার দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে তা প্রকাশ করতে রাজি হননি তিনি।

এর আগে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বিশেষ ধার চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের কাছে পৃথক পৃথক আবেদন করা হয়। ওই আবেদনে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত আর্থিক অবস্থাও তুলে ধরা হয়। জানা গেছে, ঋণের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে ‘প্রমিসারি ডিমান্ড নোট’-এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে এই অর্থ ধার দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মাধ্যমে যেকোনো উপায়ে টাকা ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ব্যাংকগুলো। গত ২৮ ডিসেম্বর তিন দিনের জন্য এই অর্থ ধার দেয়া হয়েছে। এজন্য ব্যাংকগুলোকে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ, ১৯৭২-এর ৩৬(১) ধারা অনুযায়ী আমানতকারীদের সুরক্ষায় প্রতিটি ব্যাংকের মোট তলবি ও মেয়াদি দায়ের একটি অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। বর্তমানে প্রচলিত ধারার ব্যাংকের জন্য এ হার ১৭ শতাংশ। আর শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত ব্যাংকের জন্য সাড়ে ৯ শতাংশ। ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোকে সরকারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগের বিপরীতে সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ বা এসএলআর হিসেবে সাড়ে পাঁচ শতাংশ এবং বিধিবদ্ধ নগদ জমা সংরক্ষণ বা সিআরআর হিসেবে চার শতাংশ নগদে রাখতে হয়। কোনো ব্যাংক যদি সিআরআর রাখতে না পারে তাহলে অসংরক্ষিত অংশের ওপর ৯ শতাংশ হারে দণ্ড সুদ দিতে হয়। আর এসএলআর রাখতে ব্যর্থ অংশের ওপর ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে জরিমানা আরোপ হয়। কোনো ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে ৪২ দিন ব্যর্থ হলে পরে বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশের ৩৬(৫)(এ) অনুযায়ী প্রত্যেক পরিচালককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করতে হবে। এরপরও বিধিবদ্ধ জমা সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে ৩৬(৫)(বি) অনুযায়ী নতুন আমানত নেয়া বন্ধ করতে হবে।

সূত্রগুলো বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ ধার নেয়া ব্যাংকগুলো অনেক দিন ধরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত নগদ জমার হার (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমার হার (এসএলআর) সংরক্ষণ করতে পারছিল না। এসএলআরের জন্য এসব ব্যাংকের কাছে যেসব ট্রেজারি বিল ও বন্ড ছিল, তা বন্ধক রেখে ধার করা টাকা খরচ করে ফেলেছিল। নতুন করে ধার নেয়ার কোনো উপায়-উপকরণ ছিল না। কেবল আগে নেয়া ধারের মেয়াদ বাড়াচ্ছিল।

এর আগে ২০২২ সালেও ব্যালেন্স শিট ভালো দেখাতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ১৪ হাজার ৭৯০ কোটি টাকার বিশেষ ধার দিয়েছিল কিছু ব্যাংককে। এক দিনের জন্য ওই ধারের সুদহার ছিল ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

জানা যায়, বিশেষ সুবিধার বাইরে গত ২৮ ডিসেম্বর বিভিন্ন ব্যাংকের সিকিউরিটি লিয়েন করে ধারের পরিমাণ ছিল আরও ১৭ হাজার ২১৯ কোটি টাকা।