শেখ আবু তালেব: কভিড-১৯-এর ধাক্কায় স্থবির হওয়া অর্থনীতিতে গতি আনতে বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা ঋণ প্যাকেজের ঘোষণা করা হয়। কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) আকারের উদ্যোক্তাদের জন্য রাখা হয় ২০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু দেশের সাতটি ব্যাংক গত এখন পর্যন্ত এ খাতে কোনো ঋণই বিতরণ করেনি। এর মধ্যে দুটি বেসরকারি ও পাঁচটি বিদেশি খাতের। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ব্যাংকগুলোর আমানত, ঋণ বিতরণের পরিমাণ ও খাত, শাখা সংখ্যা ও তহবিল ব্যয় ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী, সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে সিটি ব্যাংক এনএ’র লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয় মাত্র ছয় কোটি টাকা। এছাড়া হাবিব ব্যাংকের চার কোটি, এইচএসবিসির ২৪ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ১০ কোটি, উরি ব্যাংকের ছয় কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণ তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ কয়টি ব্যাংক গত ২২ অক্টোবর পর্যন্ত এক টাকার ঋণও বিতরণ করেনি।
অন্যদিকে বেসরকারি খাতের মধ্যে সীমান্ত ব্যাংকের ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে মাত্র ৫০ লাখ টাকা, যা একক ব্যাংক হিসাবে সবচেয়ে কম। নতুন ব্যাংক হওয়ায় সর্বনি¤œ পরিমাণ নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এ ব্যাংকটিও একটি টাকাও বিতরণ করেনি। এছাড়া বেসরকারি খাতের আরও একটি ব্যাংক হচ্ছে আইসিবি ইসলামিক। এ ব্যাংকটিও ২০ কোটি টাকা বিতরণের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে কোনো ঋণই বিতরণ করেনি।
জানা গেছে, দেশে কার্যরত ৯টি বিদেশি ব্যাংকের স্থানীয় শাখাগুলোকে সিএমএসএমই খাতে মোট ১৯৪ কোটি টাকা বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। গত ২২ অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র ২৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকা বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। অবশ্য কয়েকটি ব্যাংক এ খাতের ঋণ বিতরণে বেশ ভালো করেছে। এর মধ্যে আল-ফালাহ ব্যাংক ১০ কোটি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকাই বিতরণ সম্পন্ন করেছে। ১৪ জন ঋণ গ্রহীতার মধ্যে এ পরিমাণ ঋণ দেওয়া হবে। বিতরণের হার ৯৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। ঋণ বিতরণের হার বিবেচনায় যা ব্যাংক খাতের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এছাড়া কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন ২৪ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বিতরণ করেছে ১৩ কোটি ৭২ লাখ, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ১০০ কোটি টাকার মধ্যে পাঁচ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ১০ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ৪০ লাখ টাকা বিতরণ করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বিদেশি ব্যাংকগুলো এক থেকে দুই শতাংশ অর্থাৎ স্বল্প সুদে আমানত পেয়ে থাকে। অনেক সময়ে সুদ ছাড়াই আমানত পেয়ে থাকে, যা বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো পায় না। কিন্তু ব্যাংকগুলো দেশের অর্থনীতিতে তেমন সহায়ক ভূমিকায় তেমন আগ্রহ দেখায় না।
ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে। তাদের সুবিধার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালা করেছে, ব্যাংক নিজে সরাসরি বা কোনো এজেন্টের মাধ্যমেও এ ঋণ দিতে পারবে। কিন্তু বারবার নির্দেশনা দেওয়ার পরও ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে আগ্রহী হচ্ছে না।
জানা গেছে, সিএমএসএমই খাতের ঋণগুলো সাধারণত ছোট আকারের হয়। ঋণ মঞ্জুরসহ সব ধরনের প্রক্রিয়া অন্যান্য বড় আকারের ঋণ মঞ্জুরের মতোই। এতে বেশি কাজ করতে হয়। এজন্য এ খাতের ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো আগ্রহ দেখায় না খুব একটা। অন্যদিকে শুধু মৌখিক ভর্ৎসনা ছাড়া তেমন শাস্তির প্রক্রিয়ায় যায় না বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে অতীতেও অধিক মুনাফার করপোরেট ঋণ ছাড়া অন্যান্য ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি।
এবার অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা করেছে, প্রণোদনা ঋণ প্যাকেজ বাস্তবায়ন না করলে ব্যাংকগুলোকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। তবে কী শাস্তি দেওয়া হবে, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক স্পষ্ট কোনো ধারণা দেয়নি। শুধু জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে থাকা বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহƒত হবে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিং কমিয়ে দেওয়া।
সিএমএসএমই খাতের ঋণ বিতরণে বেসরকারি খাতের প্রচলিত সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর ১০ হাজার ৫৭৯ কোটি ও ইসলামি ধারার জন্য পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য দুই হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা, বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৭০ কোটি টাকার। এছাড়া ৫৮৪ কোটি টাকা বিতরণ করা হবে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) মাধ্যমে।
গত ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো এই সিএমএসএমই খাতে মোট পাঁচ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। এ পরিমাণ ঋণের সুবিধাভোগী হচ্ছে ৩২ হাজার ১৭৩ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি। ঋণ বিতরণের হার ২৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
এ ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হয় ৯ শতাংশ। এর মধ্যে সাড়ে চার শতাংশ সরকার দেবে, বাকি সাড়ে চার শতাংশ ব্যাংককে দেবেন উদ্যোক্তারা। এ ঋণ বিতরণে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেডিট রিস্ক গ্যারান্টি স্কিম ঘোষণা করে।