সাত মাসে পাসপোর্টের ১৪ কার্যালয়ে দুদকের অভিযান

নজরুল ইসলাম: পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সেবা প্রদানে হয়রানি ও ঘুষ গ্রহণসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। দালালদের দৌরাত্ম্যেও ভুগতে হয় সেবাপ্রত্যাশীদের। একই চিত্র সারাদেশে। এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে অভিযান পরিচালনা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যশোর, ভোলা, সিলেট, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, মৌলভীবাজার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, মাদারীপুর, গাজীপুর, কুমিল্লা ও গাইবান্ধা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস এবং আগারগাঁওয়ের পাসপোর্ট অফিসের প্রধান কার্যালয় ও উত্তরার ই-পাসপোর্ট কমপ্লেক্সে এসব অভিযান পরিচালনা করা হয়। গত এপ্রিল থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সাত মাসে এসব অভিযান পরিচালনা করা হয়। এর মধ্যে মৌলভীবাজার কার্যালয়ে দু’বার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, আগারগাঁওয়ের পাসপোর্ট অফিসের প্রধান কার্যালয় ও উত্তরার ই-পাসপোর্ট কমপ্লেক্সের বেসিক সেন্ট্রাল ক্লিয়ারেন্সে কর্মরত কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে দালাল বা দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের নিয়মিত যোগাযোগ ও আর্থিক লেনদেনের সত্যতা পাওয়া গেছে। তারা বিকাশ, নগদ ও ব্যাংকের মাধ্যমে দুর্নীতির অর্থ লেনদেন করে থাকে।

গত ২ অক্টোবর যশোর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দুদকের যশোরের সহকারী পরিচালক মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের একটি টিম অভিযান পরিচালনা করেছে। পাসপোর্টের জন্য অনলাইনে আবেদন ফরম পূরণ ও জমাদান প্রক্রিয়ার সঙ্গে কম্পিউটার দোকান মালিকদের সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ রয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে।

২৭ সেপ্টেম্বর ভোলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এতে দুদকের সহকারী পরিচালক শাহাজাহান মিরাজ নেতৃত্ব দেন। পাসপোর্টের অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে কতিপয় ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ও পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারীদের যোগসাজশ রয়েছে। এ বিষয়ে পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সেবাপ্রত্যাশীদের পাসপোর্ট প্রদানের ক্ষেত্রে হয়রানির অভিযোগ ছিল। ৮ সেপ্টেম্বর দুদকের সহকারী পরিচালক আশরাফ উদ্দিনের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের টিম অভিযান পরিচালনা করেছে। সেবা গ্রহীতারা জানিয়েছেন তারা নিজেরা ফরম পূরণ করে জমা দিলে তাদের আবেদনে ত্রুটি-বিচ্যুতির অজুহাতে আবেদন ফেরত দেয়া হয়। ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে ফরম পূরণ হয়ে এলে ফেরত দেয়া বা বাতিল করা হয় না। ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে পূরণ করা আবেদনে বিশেষ চিহ্ন দেয়া থাকে বিধায় তাদের হয়রানির শিকার হতে হয় না। মূলত পাসপোর্ট গ্রহীতাদের ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে আবেদন করতে বাধ্য করা হয়। এভাবে সাধারণ সেবাগ্রহীতাদের ব্যাপকভাবে হয়রানি করা হয়। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে।

কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পাসপোর্ট প্রদানে ঘুষ দাবি ও হয়রানির অভিযোগের বিষয়ে গত ২৪ আগস্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। দুদকের সহকারী পরিচালক নীলকমল পালের নেতৃত্বে সহকারী পরিচালক বিশ্বনাথ আনন্দ, রকিবুল ইসলাম ও উপসহকারী পরিচালক সৈয়দ মাইদুল ইসলাম, আবু তালহা, আশিকুর রহমান এবং সুরাইয়া সুলতানা অভিযান পরিচালনা করেন। পাসপোর্ট অফিসের সামনে অবস্থিত সায়মা টেলিকমের মালিক মহিবুল ইসলাম ও লিটন এন্টারপ্রাইজের কর্মচারী রিপনের কাছ থেকে নগদ অর্থসহ গ্রাহকদের নামে বিপুল পরিমাণ ডেলিভারি সিøপ উদ্ধার করা হয়। তারা উভয়েই পাসপোর্ট অফিসে দীর্ঘদিন ধরে দালালির সঙ্গে যুক্ত। অভিযানকালে দেলোয়ার হোসেন, সাবেক আনসার সদস্য মহিবুল ইসলাম ও রিপনকে হাতেনাতে আটক করা হয়। কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে মহিবুল ইসলাম ও দেলোয়ার হোসেনকে ৩ মাসের ও রিপনকে ১ মাসের কারাদণ্ডসহ প্রত্যেককে নগদ ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। নথিপত্র পর্যালোচনা ও সুবিধা ভোগীদের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রাহক হয়রানি ও অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগের সঙ্গে অফিসে কর্মরত আনসার সদস্যদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। পাসপোর্টের সহকারী পরিচালক জাহিদুল ইসলামকে এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে টিম সন্তোষজনক উত্তর পায়নি।

সাতক্ষীরার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পাসপোর্ট প্রদানে ঘুষ দাবি ও হয়রানির অভিযোগ ছিল। দুদকের সহকারী পরিচালক আল-আমীনের নেতৃত্বে গত ১৬ আগস্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। দুদক টিম প্রথমে ছদ্মবেশে সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে অভিযান পরিচালনা করে অনিয়মের তথ্য সংগ্রহ করে। পরে পাসপোর্টের সহকারী পরিচালক সাহজাহান কবিরের কক্ষে গিয়ে তার সঙ্গে অভিযোগের বিষয়ে আলোচনা করা হয়।

মৌলভীবাজারের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে গত ২ আগস্ট দুদকের উপপরিচালক কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে উপসহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান চৌধুরী, কামরুজ্জামান ও শাহীন কাওসারের সমন্বয়ে একটি অভিযান পরিচালনা করা হয়। পাসপোর্ট অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহকারী পরিচালকসহ আরও কয়েকজন কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে গত ২৬ জুন দুদকের উপসহকারী পরিচালক সুদীপ কুমার চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি অভিযান পরিচালনা করা হয়।

চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে গত ২২ জুন দুদকের সহকারী পরিচালক নীলকমল পালের নেতৃত্বে উপসহকারী পরিচালক মহসীন আলী, আশিকুর রহমান ও আবু তালহার সমন্বয়ে গঠিত টিম একটি অভিযান পরিচালনা করে। কয়েকজন সেবাগ্রহীতা জানান, দালালের দৌরাত্ম্য রয়েছে।

মাদারীপুর জেলার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস কার্যালয়ে নতুন পাসপোর্ট প্রদান ও নবায়নে দালালদের মাধ্যমে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ ছিল। গত ১৩ জুন দুদকের উপপরিচালক আতিকুর রহমানের নেতৃত্বে ও মাদারীপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবিএম সারোয়ার রাব্বীর উপস্থিতিতে একটি অভিযান পরিচালনা করা হয়। সরকার নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত ফি গ্রহণে সরাসরি দালালদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। ঘটনাস্থল থেকে পারভেজ মোল্লা, আব্দুর রব ব্যাপারী, নন্দ সরকার ও রাজু খান নামের চারজন দালালকে হাতেনাতে আটক করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের ১ মাসের জেল ও ৫০০ টাকা করে জরিমানা করা হয়। আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক সুমনা শারমিন শাওনকে দালালদের তালিকা তৈরি করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। একইসঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের দায়িত্বরত আনসার সদস্য শাহজাহানকে প্রত্যাহারের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।

গাজীপুর পাসপোর্ট অফিসে গত ৮ জুন দুদকের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ শিহাব সালাম, উপসহকারী পরিচালক ওয়াহিদ মঞ্জুর সোহাগ ও আমিনুল ইসলামের সমন্বয়ে একটি অভিযান পরিচালনা করা হয়। তখন  পাসপোর্ট অফিসের আশপাশে থাকা দালালরা পালিয়ে যায়। অভিযোগের বিভিন্ন বিষয়ে পাসপোর্টের সহকারী পরিচালক আনিসুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি জানান, মাত্র ৭ জন কর্মচারী দিয়ে অফিস চলছে। তাই দালালরা সুযোগ নিচ্ছে। তিনি দালালদের দৌরাত্ম্য কমাতে নিয়মিত কাজ করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেন।

কুমিল্লা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট প্রদানে সরকার নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত অর্থ দাবির অভিযোগ যাচাইয়ে গত ১ জুন দুদকের উপপরিচালক এইচএম আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি অভিযান পরিচালনা করা হয়। পাসপোর্ট অফিসের পাশের ছবি তোলার স্টুডিও, পাসপোর্টের প্রাথমিক আবেদন করার জন্য বাণিজ্যিক কম্পিউটার সেন্টার পরিদর্শন এবং কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালক নুরুল হুদা জানান, অতিরিক্ত ফি আদায়ে কিছু দালাল সম্পৃক্ত রয়েছে।

গাইবান্ধা আঞ্চলিক পাসপার্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সেবা প্রদানে ঘুষ দাবির অভিযাগে পেয়ে দুদকের উপসহকারী পরিচালক একেএম নূরে আলম সিদ্দিকের নেতৃত্বে গত ১৬ মে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদে হয়রানিমূলক ঘটনার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।

মৌলভীবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে গত ১৯ এপ্রিল দুদকের হবিগঞ্জের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শোয়ায়েব হোসেনের নেতৃত্বে একটি অভিযান পরিচালনা করা হয়। পাসপার্ট অফিসের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মোবাইল ফোনের কল লিস্ট এবং হোয়াটসঅ্যাপের কল লিস্ট ও মেসেজের অডিও রেকর্ড পর্যালাচনা করা হয়। মেসেজ ও রেকর্ড পর্যালোচনায় একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও চারজন আনসার সদস্যের মোবাইল ফোনে বহিরাগতদের সঙ্গে যোগাযোগ ও টাকা লেনদেনের মেসেজ ও কল রেকর্ড পাওয়া যায়। পাসপার্ট অফিসের প্রবেশ মুখে আনসার সদস্য হানিফের কাছ থেকে একজন সেবা গ্রহীতার রেকর্ডপত্র পাওয়া যায়।

ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অধীন সমগ্র আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের জমা হওয়া আবেদনের বেসিক সেন্ট্রাল ক্লিয়ারেন্সের কয়েকজন কর্মচারীর সহযোগিতায় গোপন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রণজিৎ কুমার কর্মকার ও সাহিদুর রহমানের সমন্বয়ে ৩ সদস্যের এনফোর্সমেন্ট টিম গত ১৮ এপ্রিল একটি অভিযান পরিচালনা করেছে। অভিযোগ যাচাই ও সত্যতা উদ্ঘাটনের জন্য সরেজমিন আগারগাঁওয়ের পাসপোর্ট অফিসের প্রধান কার্যালয় এবং উত্তরার ই-পাসপোর্ট কমপ্লেক্সের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মোবাইল ফোন পর্যালোচনা করা হয়। অভিযানকালে বেসিক সেন্ট্রাল ক্লিয়ারেন্সে কর্মরত কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে দালাল বা দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের নিয়মিত যোগাযোগ ও আর্থিক লেনদেনের সত্যতা প্রাথমিকভাবে টিমের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। বিকাশ, নগদ ও ব্যাংকের মাধ্যমে দুর্নীতির অর্থ লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০