নিজস্ব প্রতিবেদক: আগস্টের প্রথম দিন থেকে বাংলাদেশ-ভারতের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল-পেট্রাপোলে ২৪ ঘণ্টা বাণিজ্যের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানকার অপ্রশস্ত রাস্তা, দুর্বল অবকাঠামো, প্রশাসনিক দুর্বলতা, প্রযুক্তির অপর্যাপ্ত ব্যবহার, জনশক্তির অভাবসহ নানা কারণে বাস্তবে তেমন কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়নি। বাংলাদেশ প্রান্তে কার্যত বাণিজ্য কার্যক্রম পরিচালিত হয় মাত্র চার ঘণ্টা। ভারতীয় পেট্রাপোল প্রান্তে অবকাঠামো ও ডিজিটাইজেশন খানিকটা ভালো হলেও চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক প্রভাবের আধিক্য রয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের একটি গবেষণায় এসব কথা বলা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সংস্থাটির গুলশান কার্যালয়ে এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। এ গবেষণায় অন্যান্যের মধ্যে সানেমের গবেষক মো. নাজমুল অভি হোসেন, মো. জাহিদ ইবনে জালাল ও মো. সাদাত আনোয়ার যৌথভাবে কাজ করেন। ‘বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধি: বেনাপোল ও পেট্রাপোল স্থলবন্দরের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের প্রস্তুতি’ শীর্ষক এ গবেষণায় উভয় দেশের স্টেকহোল্ডারদের অভিমত এবং সরেজমিনে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়।
গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে ড. সেলিম রায়হান বলেন, ভারতের যেকোনো প্রান্ত থেকে একটা ট্রাক বনগাঁও আসতে পাঁচ-ছয় দিন লাগে। অথচ বনগাঁও থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার পথ আসতে ট্রাকগুলোর ১৫ দিনের বেশি লেগে যায়। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকেও কাস্টমসের কাজ শেষ করতে প্রায় ১৫ দিন লাগে। মূলত দুই দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধিতে রাজনৈতিক পর্যায়ে যে আগ্রহ রয়েছে তা কাস্টমস এবং আমলাতন্ত্রের মধ্যে নেই। এছাড়া সেখানকার অবকাঠামো খুবই অপ্রতুল বিপুল বাণিজ্যের জন্য। বেনাপোল ও পেট্রাপোলের সক্ষমতা বাড়ালে ভারতের বাজারে বাংলাদেশের রফতানি এক বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা সম্ভব বলে মত দেন তিনি।
গবেষণায় বলা হয়, ভারত ও বাংলাদেশের মোট দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ স্থল বাণিজ্য হয়ে থাকে বেনাপোল ও পেট্রাপোল দিয়ে। সে হিসেবে এ দুটি বন্দর হচ্ছে স্থলপথে এশিয়ার বৃহত্তম স্থলবন্দর। পেট্রাপোল স্থলবন্দরের হিসাব থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের চার বিলিয়ন ডলারের প্রায় অর্ধেকই আসে এই স্থলবন্দর থেকে, যা পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের মোট বাণিজ্যের প্রায় দ্বিগুণ। ভারত থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩৫০টি ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন গড়ে ৭০-৮০টি ট্রাক ভারতে প্রবেশ করে।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বেনাপোল স্থলবন্দর ২৪ ঘণ্টা এবং সপ্তাহের সাত দিন চালু থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে কর্মসময় এর চেয়ে কম। সেখানে মূলত সকাল ১০টা থেকে কার্যক্রম শুরু হয় এবং বেলা ২টার পর আর কোনো ট্রাকের পণ্যদ্রব্য খালাস করা হয় না। সেখানে কাস্টমসের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকলেও মূলত লোড-আনলোডের জন্য শ্রমিকদের পাওয়া যায় না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বেনাপোল বন্দরের পণ্য মজুদ করার ক্ষমতা ৪০ হাজার টন। কিন্তু সেখানে অন্তত এক লাখ টন পণ্য নিকটস্থ লোকালয়ের কাছে বিভিন্ন গুদামে স্ত‚প করে রাখা আছে। স্থান সংকুলান না হওয়ার জন্য ট্রাকগুলো প্রায়ই খোলা জায়গায় অবস্থান করে। দেখা গেছে, দিনে গড়ে ৩২৫-৩৫০টি ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, অথচ ভারতীয় প্রান্তে পেট্রাপোল বন্দরের ইন্টিগ্রেটেড চেক পোস্টে (আইসিপি) প্রায় দেড় হাজার ট্রাক আটকে থাকে। এছাড়া বেনাপোল বন্দরে এখন ৪৩টি পণ্য রক্ষণাবেক্ষণ ছাউনি আছে, যেগুলো অনেক পুরোনো, জরাজীর্ণ এবং ময়লা আবর্জনায় আচ্ছাদিত। এছাড়া সীমান্তমুখী রাস্তাগুলো সরু এবং সাধারণ যানবাহনে ভর্তি থাকায় পণ্য ও যানবাহন চলাচলে বিঘœ ঘটাচ্ছে।
এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে চালানো জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৯২ শতাংশ ব্যবসায়ী সেখানকার অবকাঠামো সন্তোষজনক বলে মনে করেন না। এছাড়া প্রায় ৯০ শতাংশ ব্যবসায়ী বন্দর ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি ও ডিজিটাল সিস্টেম পর্যাপ্ত নয় বলে মত দিয়েছেন। ৮৭ শতাংশ ব্যবসায়ী বেনাপোলের সামাজিক ও স্থানীয় পরিবেশকে বন্দরের কাজের জন্য উপযুক্ত মনে করছেন না।
অন্যদিকে ভারতীয় প্রান্তের পেট্রাপোল বন্দরের বিষয়ে ব্যবসায়ীদের মাঝে করা জরিপ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ৭৮ শতাংশ ব্যবসায়ী ডিজিটাল ব্যবস্থাকে অপ্রতুল মনে করেন, ৫৭ শতাংশ ভারতীয় অবকাঠামোকে অপর্যাপ্ত মনে করেন এবং ৯১ শতাংশ ব্যবসায়ী ওই প্রান্তের সামাজিক ও স্থানীয় পরিবেশকে বাণিজ্যবান্ধব বলে মনে করছেন না। জানা যায়, ওই প্রান্তে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠী রয়েছে, যাদের চাঁদা দিয়ে ট্রাকগুলোকে বাংলাদেশে আসতে হয়।
গবেষকরা জানান, বাংলাদেশ অংশে কোনো রিস্ক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম না থাকলেও ভারতীয় অংশে রয়েছে, কিন্তু সেখানেও তার ব্যবহার হচ্ছে না। গবেষণার সুপারিশে দুই দেশের কাস্টমস কর্তৃপক্ষের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করার আহবান জানানো হয়। এছাড়া রাস্তা প্রশস্তকরণ ও নতুন রাস্তা নির্মাণের পরামর্শ দেওয়া হয়। সার্বিক অশুল্ক বাধাগুলোও দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগের মাধ্যমে নিরসনের পরামর্শ দেওয়া হয়।