সানেমের সম্মেলনে রেহমান সোবহান প্রভাবশালীরা দখল করছে জনপ্রতিনিধির স্থান

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে সম্পদশালীরাই এখন নির্বাচন করেন। একসময় মধ্যবিত্ত ও নি¤œ-মধ্যবিত্তরা রাজনীতিতে সরব থাকলেও এখন সে স্থান দখল করে নিচ্ছেন প্রভাবশালীরা।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (এসএএনইএম) আয়োজিত দ্বিতীয় বার্ষিক অর্থনীতিবিদ সম্মেলনের একটি অধিবেশনে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে এমন মন্তব্য করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। প্রথম দিনের শেষ অধিবেশনে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বক্তব্য রাখেন। এতে সভাপতিত্ব করেন আরেক অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। অধিবেশনের বিষয় ছিল ‘সামাজিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধি ব্যবস্থাপনা’।
রেহমান সোবহান বলেন, বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদ, তোফায়েল আহমেদরা নি¤œ-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। তারা মাঠে-ঘাটে হেঁটে রাজনীতি করেছেন। কিন্তু এখন বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিদের জায়গা দখল করে ফেলেছেন প্রভাবশালীরা। এটা তাদের এক ধরনের বিনিয়োগও। এসব কারণে অন্যায্যতা ও অসমতা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশে সুশাসন নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত বলে মনে করেন রেহমান সোবহান। তার মতে, সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হন। আবার প্রভাবশালীরা সহজেই সরকারি সেবা যেমন পান, আবার অনেকে নিয়মকানুনও মানেন না। সরকারি সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে এই দুই শ্রেণির মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে।
এ বিষয়ে রানা প্লাজার উদাহরণ দিয়ে রেহমান সোবহান বলেন, সেখানে যারা কাজ করতেন, তারা আগেই বলেছিলেনÑ ভবনটি ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু তাদের তত্ত্বাবধায়ক বাধ্য করেছিলেন কাজে যেতে। বলা হয়েছিল, কাজে না গেলে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হবে। দেখা গেল, ভবনের মালিক রানা রাজনৈতিকভাবে খুবই প্রভাবশালী। তিনি ভবন কোড মেনে ভবনটি নির্মাণ করেননি। এখানে দেখা গেছে, অর্থ ও রাজনৈতিক প্রভাবই সব নিয়ন্ত্রণ করেছে।
রেহমান সোবহান বিপরীত উদাহরণ দিয়ে বলেন, দেশের কৃষক, ছোট ছোট পণ্য উৎপাদকরা ন্যায্য দাম পান না। সরাসরি বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় তারা ন্যায্য দাম পান না। সরবরাহ ব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে প্রভাবশালীরাই থাকেন। তার মতে, কৃষক ও ছোট ছোট উৎপাদকদের প্রণোদনা দিয়ে পণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করা উচিত।
তিনি বলেন, প্রান্তিক উৎপাদকদের বাজার সুবিধা নিশ্চিত করার একটি বড় উদাহরণ হলো ভারতের আমুল ডেইরি। ২০ থকে ৩০ লাখ খামারি দুধ উৎপাদন করেন। এই দুধ দিয়ে সমাজের বনেদি শ্রেণির জন্য মাখন, পনির এসব উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশে প্রাণ কোম্পানি এভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে।
রেহমান সোবহান আরও বলেন, সমাজে বৈষম্য আছে। এটি রাজনীতিরও একটি অংশ। প্রান্তিক মানুষের ওপর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রভাব কীভাবে পড়ছে, তা দেখতে হবে। মানুষের বঞ্চনার ভিত্তিতে বৈষম্য নিরূপণ করা উচিত। এজন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সুযোগ তৈরি করা উচিত। সিঙ্গাপুর, তাইওয়ানের মতো দেশ মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করে বহুদূর এগিয়ে গেছে।
বাংলাদেশে খানা আয় ও ব্যয়ে জরিপের তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রেহমান সোবহান। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, মাঠপর্যায়ের তথ্য সংগ্রাহকরা অনেক ধনী বাসায় ঢুকতে পারেন না।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, কীভাবে মানব উন্নয়নকে উচ্চ আয়ে রূপান্তরিক করছি, সেটাই বড় বিষয়। প্রবৃদ্ধির উৎস তৈরি করে অর্থনৈতিক সুযোগ। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার মতো মানব উন্নয়ন পরিস্থিতির দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উচ্চ আয়ের দেশের মতো রূপান্তরিক করতে পারছি না। তিনি আরও বলেন, এই যুগে প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রযুক্তি খুব কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। উচ্চ বৈষম্য প্রবৃদ্ধির অর্জনের বাধা। আবার উচ্চ প্রবৃদ্ধি টেকসই করাও কঠিন। এ দুটির জন্য সহায়ক নীতি গ্রহণ করতে হয়।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থার বিভিন্ন নিয়মকানুনের কারণে এদেশের গ্রামের কৃষকদের বিশ্ববাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারছি না। তারা শুধু অভ্যন্তরীণ বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) অন্যতম লক্ষ্য তথ্য-উপাত্ত প্রাপ্তিতে ব্যাপক ঘাটতি আছে। খানা আয় ও ব্যয় জরিপে এখনও বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত তথ্য পাই।
এই অধিবেশনে আরও বক্তব্য রাখেনÑ সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান, শ্রীলঙ্কার ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজের (আইপিএস) নির্বাহী পরিচালক সামান কেলেগামা, সাউথ এশিয়া ওয়াচ অন ট্রেড, ইকোনমিকস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের (এসএডব্লিউটিইই) চেয়ারম্যান পশ রাজ পান্ডে, ভারতের ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক গ্রোথের অধ্যাপক সব্যসাচী কর প্রমুখ।
সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে যুক্তরাজ্যের আলস্টার বিশ্ববিদ্যলেয়ের ডেভেলপমেন্টাল ইকোনমিক্সের অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী তার ‘গণতন্ত্র ও উন্নয়ন’ শীর্ষক কি-নোট পেপার উপস্থাপনায় বলেন, গণতন্ত্রের চর্চা ছাড়া টেকসই প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, যেসব দেশে গণতন্ত্রের চর্চা আছে, সেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনেরও ধারাবাহিকতা আছে। আর যেসব দেশে একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বিদ্যমান, সেখানকার প্রবৃদ্ধিও ওঠানামা করে। কোনো একটি নির্দিষ্ট বছরে প্রবৃদ্ধি বেশি হলেও পরের বছরগুলোয় তার ধারাবাহিকতা থাকে না। আর গণতান্ত্রিক দেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধি না হলেও ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি হয়।
তিনি আরও বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার পরিবর্তন হয় শান্তিপূর্ণভাবে। একজন নেতার পর আরেকজন আসেন। কিন্তু পদ্ধতির কোনো পরিবর্তন হয় না। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সুবাদে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে সেসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। আর একনায়কতন্ত্রে ক্ষমতার পরিবর্তন হয় সংঘর্ষমূলক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। ফলে একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সময় যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, সেগুলোও বিলুপ্ত অথবা অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে এক ধরনের শূন্যতা পরীলক্ষিত হয়।
তবে গণতন্ত্রের চর্চা রাতারাতি সফল হয় না বলে তিনি মনে করেন। আর সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির জন্য সেই ধরনের নাগরিক মূল্যবোধসম্পন্ন জনগোষ্ঠী অপরিহার্য। এমন নাগরিক তৈরিতে প্রয়োজন সামাজিক সংস্কৃতির উন্নয়ন। পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন। তার মানে এই নয় যে, গণতন্ত্রের জন্য আগে প্রস্তুতি নিয়ে তারপর এটির চর্চা শুরু করতে হবে। এটির চর্চা শুরু করে দিয়ে এক ধরনের সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে যেতে হবে রাষ্ট্রকে। এর ধারাবাহিকতায় একসময় দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে।
আরেক কি-নোট উপস্থাপনায় ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যায়ন বিভাগের অধ্যাপক ডেভিড হিউম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব দেশ সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশ অন্য কোনো দেশের ওপর নির্ভরশীল না থেকে নিজ চেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে।
সানেমের চেয়ারম্যান বজলুল হক খন্দকারের সভাপতিত্বে এতে আরও উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।
দুপুরের একটি অধিবেশনের বিষয় ছিল প্রবৃদ্ধির রাজনীতি। এই অধিবেশনে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যবসায়ীরা বেশ প্রভাবশালী। আবার আমলাতন্ত্রও ব্যবসায়ীদের সহায়তা করেন। সুশাসেনর ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
এই অধিবেশনের সভাপতি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, নব্বইয়ের দশকে ব্যাংক, স্থানীয় সরকার, টেলিযোগাযোগ ও অবকাঠামো খাতে ব্যাপক সংস্কার হয়েছে। তাই সুশাসনের দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধিও হয়েছে।
এ অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গর্ভন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) গবেষক মির্জা এম হাসান, ভারতের ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক গ্রোথের অধ্যাপক সব্যসাচী কর।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০