রোহান রাজিব: এক সময়কার দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ছিল চট্টগ্রামের সানোয়ারা গ্রুপ। এদের দুই প্রতিষ্ঠানটিকে বিশ্বাস করে জামানত ছাড়াই ৩৭ কোটি টাকার ঋণ দেয় উত্তরা ব্যাংক। ঋণ দেয়ার ১৪ বছর পরও কোনো অর্থ পরিশোধ করেনি প্রতিষ্ঠান দুটি। এখন বিশ্বাসের সেই ঋণ আদায় নিয়ে বিপাকে রয়েছে বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজšে§র ব্যাংকটি। ঋণ আদায় না হওয়ার কারণে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানের ঋণ খেলাপি করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। উত্তরা ব্যাংকেও সানোয়ারার গ্রুপের ঋণ খেলাপি করার নির্দেশ দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জানা যায়, ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকদের তালিকায় ছিল সানোয়ারা গ্রুপ। এছাড়া দেশের আইসক্রিমের বাজারে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে গ্রুপটির ‘কোয়ালিটি আইসক্রিম’। ব্যবসায় ভর করেই চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম বিএসসি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এক সময় দায়িত্ব পালন করেছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী হিসেবেও। কিন্তু বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি অবসরে যাওয়ার পর তার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী গ্রুপটি দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে এসে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন ব্যাংক ঋণের সামান্য টাকাও পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে সানোয়ারা গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠান।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০০৮ সালের ৩ মার্চ সানোয়ারা ডেইরি ফুডস ও ইউনিল্যাক সানোয়ারা বিডি লিমিটেডকে ২০ কোটি টাকার এলসি ঋণসীমা ও ১৫ কোটি টাকার বিশ্বাসের ঋণ (এলটিআর-লোন এগেনস্ট ট্রাস্ট রিসিট) এবং ২ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি ঋণ সুবিধা প্রদান করে উত্তরা ব্যাংকের চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখা। ওই ঋণের বিপরীতে আদায় না থাকায় ২০১৫ সালের ১১ জুন ঋণটি খেলাপিযোগ্য হয়ে পড়ে। এই ঋণের ক্ষেত্রে সানোয়ারা গ্রুপকে উত্তরা ব্যাংক অবৈধ সুবিধা দিয়েছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা আর্থিক খাতের সুশাসনের পরিপন্থি।
নানা নাটকীয়তার পর ২০২২ সালে ঋণ দুটির পুনঃতফসিল করতে ব্যাংকের দ্বারস্থ হয় সানোয়ারা কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে ঋণের ত্রৈমাসিক কিস্তির (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ৫০ শতাংশ পরিশোধ করতে হতো। ঋণ দুটির ত্রৈমাসিক কিস্তির পরিমাণ ১ কোটি ৪ লাখ ২২ হাজার টাকা দাঁড়ায়। সেক্ষেত্রে সানোয়ারাকে পরিশোধ করতে হতো ৫২ লাখ ১১ হাজার টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এই অর্থ পরিশোধেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
জানা যায়, প্রথমে ৫০ লাখ ১৬ হাজার টাকা নগদ পরিশোধের পাশাপাশি ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার ২টি চেকে প্রদান করে। পরে অবশ্য এই আড়াই লাখ টাকা নগদ পরিশোধ করে ঋণের পুনঃতফসিল করেছে বলে দাবি উত্তরা ব্যাংকের। তবে কিস্তি পরিশোধ আইনসম্মত না হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটিকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করতে নির্দেশ দিয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, সানোয়ারা গ্রুপের এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে তিন বছর (২০১৫ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই) যাতে খেলাপি দেখানো না হয় এজন্য তারা ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই আদালতের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু আদালত গ্রুপটির রিট আবেদন বাতিল করে দেয়। এ দুটি ঋণের বিপরীতে উত্তরা ব্যাংক কোনো ধরনের জামানত গ্রহণ না করায় বর্তমানে এটি জামানতবিহীন বিদ্যমান রয়েছে। পরে কোনো উপায় না পেয়ে ২০১৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সানোয়ারা গ্রুপের দুটি ঋণ ৮ বছরের জন্য প্রথম পুনঃতফসিল করে। ওই সময় উত্তরা ব্যাংকের শাখা বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সরেজমিন প্রতিবেদন ছাড়াই ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। বিআরপিডি সার্কুলার ৫১ মোতাবেক ২০২২ সালের জুন-সেপ্টেম্বরে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের ত্রৈমাসিক কিস্তির ৩০ শতাংশ অর্থ গ্রহণ না করেই এটি পুনঃতফসিল করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে। এজন্য ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ দুটি মেয়াদোত্তীর্ণ ও গুণগতমানের ভিত্তিতে ক্ষতিজনক মানে খেলাপি হিসেবে দেখিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবিতে অবহিত করার জন্য নির্দেশ দেয় উত্তরা ব্যাংককে।
এদিকে, ঋণের দায় থেকে নিজেকে মুক্ত করতে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে নুরুল ইসলাম বিএসসির ব্যক্তিগত জামানত থেকে দায় মুক্তি চেয়ে ব্যাংকের কাছে আবেদন করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তার পার্সোনাল গ্যারান্টি রিলিজ না করার নির্দেশ দিয়েছে।
এ বিষয়ে জানার জন্য উত্তরা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রবিউল হাসানের সঙ্গে একাধিক মাধ্যমে যোগাযোগ ও এসএমএস করলেও কোনো উত্তর দেননি। পরে তার বক্তব্য নেয়ার জন্য প্রতিবেদক ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে গিয়েও দেখা করতে ব্যর্থ হন।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের সফল শিল্পোদ্যোক্তা, শিক্ষানুরাগী ও রাজনীতিক নুরুল ইসলাম বিএসসি ১৯৭৮ সালে কাস্টমসের চাকরি ছেড়ে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা শুরু করেন পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে। অল্প সময়েই ভোগ্যপণ্য আমদানি ও ব্যবসায় বেশ সুনাম অর্জন করে তার প্রতিষ্ঠান ‘সানোয়ারা করপোরেশন’। বনে যান দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক। ভোগ্যপণ্য ব্যবসার পাশাপাশি ১৯৭৮ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়ান গুঁড়াদুধের ব্র্যান্ড রেডকাউয়ের একমাত্র বাংলাদেশি এজেন্ট ছিল সানোয়ারা করপোরেশন।
২০০৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৫ বছর রেডকাউ নিয়ে সফল ব্যবসা করে সানোয়ারা। ব্যবসা সম্প্রসারণ করে ১৯৮৭ সালে ৩০০ একর জমিতে সানোয়ারা পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি গড়ে চট্টগ্রামের পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি শিল্পের পথিকৃৎ হিসেবে আবির্ভূত হন নুরুল ইসলাম বিএসসি। এছাড়া ১৯৯১ সালে ইউনিল্যাক সানোয়ারা (বিডি) লিমিটেড, ১৯৯৫ সালে সানোয়ারা ডেইরি অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, ১৯৯৮ সালে সানোয়ারা ড্রিংকস অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজসহ বেশ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন নুরুল ইসলাম বিএসসি।
চান্দগাঁও শিল্প এলাকায় ইউনিল্যাক সানোয়ারা (বিডি) লিমিটেডের মাধ্যমে গুঁড়াদুধ আমদানি ও রিপ্যাকিং করা হতো। একসময় এই কারখানায় ডিপ্লোমা ফ্যালকন ব্র্যান্ডের গুঁড়াদুধ রিপ্যাকিং করে বাজারজাত করা হতো। এছাড়া ২০০৪ সালে সানোয়ারা ডেইরি ফুডস লিমিটেড নামে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন নুরুল ইসলাম বিএসসি। যেখানে কোয়ালিটি কনডেন্সড মিল্ক এবং কোয়ালিটি গুঁড়াদুধ উৎপাদন হতো। বর্তমানে গ্রুপটির অধীনে মোট ১২টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু গ্রুপটির দায়িত্ব তার সন্তানদের হাতে যাওয়ার পর দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে সানোয়ারা।