সাইফুল আলম ও সাইদ সবুজ, চট্টগ্রাম: দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) আওতায় ইস্যুকৃত সার্টিফিকেট অব অরজিনের (উদ্যোক্তা সনদ) ডিজিটাল স্বাক্ষর কপি গ্রহণ করছে না চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এতে ৫০টির অধিক আমদানিকৃত কনটেইনারের পণ্য চালান আটকে পড়ে আছে। গত ২৭ দিনের অধিক সময় বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে পড়ে থাকায় আমদানিকারকদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ডেমারেজ চার্জ। আর সময়মতো পণ্য খালাস করতে না পারলে বিপুল লোকসান গোনার আশঙ্কায় আছে ব্যবসায়ীরা।
যদিও সাফটা চুক্তির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পণ্যভিত্তিক সুবিধা প্রধানের মাধ্যমে সময়সাপেক্ষ জটিলতা কমানো। কিন্তু কাস্টমস বলছে তাদের করার কিছুই নেই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আদেশ দিলে পুনরায় অনলাইন ডকুমেন্ট গ্রহণ করা হবে।
আমদানিকারক সূত্রে জানা যায়, করোনাভাইরাসের কারণে বর্তমানে বিভিন্ন অফিস-আদালতের কার্যক্রম চলছে সীমিত আকারে ও অনলাইনে। সে কারণে ভারতীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ৭ এপ্রিল একটি চিঠি দিয়ে সে দেশ থেকে ইস্যুকৃত সার্টিফিকেট অব অরজিন ডিজিটাল স্বাক্ষরযুক্ত অথবা স্বাক্ষরবিহীন ইলেকট্রিক্যালি গ্রহণ করতে অনুরোধ জানায়। ৩০ জুন পর্যন্ত এভাবে কার্যক্রম চালাতে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। সেই চিঠির আলোকে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২৭ এপ্রিল এক চিঠিতে বিষয়টি এনবিআরকে জানায়। এই চিঠির আলোকে ৩০ জুনের মধ্যে ইস্যুকৃত সার্টিফিকেট অব অরজিনের মাধ্যমে পণ্য চালান খালাস হচ্ছিল।
এদিকে ৩০ জুনের পর ইস্যুকৃত কোনো সার্টিফিকেট অব অরজিন কাস্টমস কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করছে না। এ সময় কাস্টমস অরিজিলান হার্ডকপি উপস্থাপন করতে বলছে। এদিকে ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্যের বিপরীতে কোনো প্রকার হার্ডকপি সরবরাহ করছে না। ফলে আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট উভয় সংকটে পড়েছে। যদিও এরই মধ্যে ভারত থেকে আমদানিকৃত বেশকিছু পণ্য দেশের বিভিন্ন বন্দরে আটকে আছে।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে ৫০টির অধিক আমদানিকৃত কনটেইনারের পণ্য চালান আটকে পড়ে আছে। এসব কনটেইনার ২৭ দিনের অধিক সময়ে ধরে পড়ে আছে। তাতে আমদানিকৃত কনটেইনারের বিপরীতে অতিরিক্ত সময়ের জন্য আমদানিকারকদের গুনতে হবে ডেমারেজ চার্জ। অপরদিকে সময়মতো পণ্য বিক্রয় করতে না পারায় লোকসান গোনার আশঙ্কা আছে। ফলে বিভিন্ন আমদানিকারক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
জানা যায়, ২৭ দিন পার হলেও এ ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়নি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর ও ভারতীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সময় বৃদ্ধি না করার ফলে ১ জুলাই থেকে সাফটা চুক্তির অধীনে আমদানিকৃত পণ্য ডিজিটাল স্বাক্ষর কপি দিয়ে ছাড় দিচ্ছে না কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে ঢাকার মৌলভী বাজারের ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাফেজ মো. এনায়েতুল্লাহ্ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘গত ১ জুলাই থেকে অনলাইন ডকুমেন্ট গ্রহণ করছে না চট্টগ্রাম কাস্টমস। অথচ ভারত সরকার করোনা পরিস্থিতিতে সব ধরনের হার্ডকপি বন্ধ করে দিয়েছে। তারা সব ডকুমেন্ট অনলাইনের মাধ্যমে গ্রহণ ও প্রদান করছে। ফলে আমাদের কাছে কোনো প্রকার হার্ডকপি না থাকায় কাস্টমসকে সরবরাহ করতে পারছি না।
আর কাস্টমস বলছে অনলাইনে ডকুমেন্ট গ্রহণ করবে না। অথচ অনলাইনে স্বচ্ছতা বেশি থাকে এবং প্রতিটি ডকুমেন্টে বারকোড থাকায় সহজে স্বচ্ছতা যাচাই করা যায়। এছাড়া ভারতীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়েও এসব ডকুমেন্ট সহজে যাচাই করা যাবে।’
খাতুনগঞ্জ পাইকারি বাজারের মশলাজাতীয় পণ্যের আমদানিকারক অসীম কুমার দাশ বলেন, ‘মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে একদিকে ব্যবসা প্রায় বন্ধের পথে, অন্যদিকে আমদানি পণ্য খালাস করতে না পেরে দিন দিন বন্দরের গুদাম ভাড়া বেড়েই চলছে। এর সঙ্গে রয়েছে ঈদের ছুটি। আমদানিকৃত এসব পণ্য চালান কবে ছাড় হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন আমদানিকারকরা।’
তিনি বলেন, ‘সাফটা আওতায় পণ্য আমদানিতে বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো যে দেশ থেকে পণ্য আসবে সে দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরযুক্ত মূল কপি আমদানিকারককে নিজ নিজ কাস্টম হাউসে অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হবে। সেই সঙ্গে এনবিআরের অনলাইনেও একটি স্বাক্ষরযুক্ত কপি পাঠাতে হবে। এতদিন এভাবে পণ্য চালান খালাস হচ্ছিল কাস্টমস হাউস থেকে।’
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ভোগ্যপণ্য আমদানির (শুল্ক সেকশন ০১) দায়িত্বে থাকা যুগ্ম কমিশনার সাধন কুমার কুন্ড শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এসআরওর বাধ্যবাধকতা থাকায় ১ জুলাই থেকে ডিজিটাল সনদ গ্রহণ করছে না কাস্টমস। এনবিআর আমাদের আদেশ দিলে আমরা আবার ডিজিটাল সনদ গ্রহণ করব। এতে আমদানিকারদের অসুবিধা হচ্ছে কথাটা সত্য। কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই। তবে এ সমস্যা সমাধান করতে হলে কাস্টমস অথবা আমদানিকারকের পক্ষ থেকে এনবিআরকে সময় বাড়ানোর জন্য আবার চিঠি দিতে হবে।’
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার ফখরুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এখানে আমাদের ব্যবস্থা নেওয়ার কিছু নেই। এর আগে এনবিআর এক চিঠির মাধ্যমে ৩০ জুন পর্যন্ত অনলাইন ডকুমেন্ট গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছিল। তারপর আর মেয়াদ বাড়ায়নি। এখানে আমাদের চিঠি দেওয়ারও কিছু নেই। তারাই তো সরাসরি এনবিআরে যেতে পারে!
এর আগে এনবিআর যে আদেশ দিয়েছিল, সেটাও তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে। তারা বাণিজ্য মন্ত্রণলায়ের সাথে আলাপ করে সরাসরি এনবিআরে তাদের সমস্যার কথা জানাতে পারে। তাদের সমস্যা তারা সমাধান না করলে আমরা কেন করব? কাস্টমস অনলাইন ডকুমন্টে গ্রহণ করছে না, কথাটা সঠিক নয়। আমাদের আদেশ দিলে আমরা কাল থেকেই পণ্য খালাস দেব।
কিন্তু তারা চুপচাপ বসে আছে কেন? তারা তো জানে ৩০ জুনের পর আটকা পড়ে যাবে। কিন্তু সব কিছু জানার পরও তারা এনবিআরে গিয়ে অ্যাপ্রোচ করছে না কেন? যদি আমরা অ্যালাউ করে আবার বন্ধ করতাম তাহলে একটা বিষয় ছিল। কিন্তু আমরা তো তা করিনি। এখন এনবিআর আদেশ দিলে কাল থেকে আবার ডকুমেন্ট গ্রহণ করব।’