সাবেক চেয়ারম্যানের দখলে ৬৪০ কোটি টাকার ঋণ

জয়নাল আবেদিন: দীর্ঘদিন থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাল (ঝুঁকিপূর্ণ) তালিকায় অবস্থান করছে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। বর্তমানে যতগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার মধ্যে ডজন খানেকের অবস্থা খুবই নাজুক। এরা গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। তাদের মধ্যে অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান বিআইএফসি। এর সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। ৫৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে বিআইএফসির ৬৪০ কোটি টাকা অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত পরিদর্শনের তথ্য অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি বিআইএফসি’র মোট শেয়ারের ৫৬ শতাংশই মেজর মান্নানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের হাতে, যা আইন পরিপন্থি। এছাড়া রইস উদ্দিন আহমেদের নামে রয়েছে ১.২৭ শতাংশ আর মহিউদ্দিন আহমেদের নামে রয়েছে ১.৮৬ শতাংশ শেয়ার। তারা দু’জনেই মেজর মান্নানের শ্যালক। পরিদর্শনে উল্লেখ করা হয়, মেজর মান্নান, তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও আত্মীয়স্বজনের নামে ৫৭ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নেয়া মোট ঋণের পরিমাণ ৬৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৬টি ঋণই এখন মন্দমানের খেলাপি।

পরিদর্শনে আরও উল্লেখ করা হয়, মেসার্স টেলিকম সার্ভিস এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স আব্দুল্লাহ ব্রাদার্স, মেসার্স রহমত উল্লাহ অ্যান্ড কোম্পানি এবং মেসার্স টাওয়ার বিল্ডার্সকে দেয়া কোনো ঋণ অনুমোদন ও বিতরণের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম পালন করা হয়নি। সব ক্ষেত্রে এক খাতের ঋণ অন্য খাতে নেয়া বা ফান্ড ডাইভার্সন করা হয়েছে। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনও ভঙ্গ করা হয়েছে।

বিআইএফসির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ৫৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ রয়েছে ডক্টর আফরোজ সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে। তিন বারে বিআইএফসি থেকে ১০০ কোটি ৫২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি; যার পুরোটাই এখন মন্দমানের খেলাপি। এছাড়া  আবদুল মান্নানের গোল্ডেন হরাইজন লিমিটেডের নামে নেয়া হয়েছে ৬৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে লিমিটেড নিয়েছে ২১ কোটি ৩০ লাখ। এছাড়া মেজর মান্নানের মালিকানাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও তার সুপারিশে ঋণ পাওয়া ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ঢাকা সিএনজি লি. ২৪ কোটি ৫৯ লাখ, সানম্যান শিপিং লি. ৪০ হাজার, মেসার্স টেলিকম এন্টারপ্রাইজ ৮৭ কোটি ৮ লাখ, রফিক উদ্দীন ১৯ কোটি ২১ লাখ, মেসার্স আলিফ এন্টারপ্রাইজ ২ কোটি ৩৪ লাখ, মেট্রো পলিটন সিএনজি লি. ৪২ কোটি ৬৬ লাখ, ইউনাইটেড ড্রেসেস লি. ২৫ কোটি ৪৬ লাখ, টেলিকম সার্ভিস লি. ৮ কোটি ৩৮ লাখ, মেসার্স ইয়াসমিন ট্রেডার্স ৯ কোটি ২৩ লাখ, মো. রইস উদ্দীন ৫ কোটি ২৩ লাখ, ম্যাক্সনেট অনলাইন ৩২ কোটি ৯ লাখ, চৌধুরী অ্যাপারেল ৬ কোটি ৬৩ লাখ, টেলিপ্লাস নিউইয়র্ক লি. ২৬ কোটি ৩৮ লাখ, মটর ট্রেড এন্টারপ্রাইজ ১৫ কোটি ৪০ লাখ, রুনা প্রপার্টিজ ১৬ কোটি ৩৯ লাখ, রহমান টেক্সটাইল ৮ কোটি ৬২ লাখ, ইস্ট এশিয়া এন্টারপ্রাইজ ৭ কোটি ৩৯ লাখ, মেসার্স টেলিকম সার্ভিস এন্টারপ্রাইজ ২৩ কোটি ৮৯ লাখ, মেসার্স টেক্সটাইল ইন্টারন্যাশনাল ৩৭ কোটি ৩২ লাখ, টাওয়ার্স বিল্ডার্স ৩৬ কোটি ৯ লাখ, ক্লিক ২ ডিজাইন লি. ৩১ কোটি ৫৫ লাখ, মেসার্স রহমতউল্লাহ অ্যান্ড কোম্পানি ৩৩ কোটি ৬৫ লাখ, মেসার্স আব্দুল্লাহ ব্রাদার্স ৩৭ কোটি ৫৭ লাখ, বিলাল ডি মামুন ৯২ লাখ, টেকনো ওয়াইফাই সার্ভিস ৮ কোটি ৩০ লাখ ও ট্রান্সকো লি. ৪৩ লাখ টাকা।

সূত্র জানায়, বিআইএফসির বিতরণ করা ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৯৭ শতাংশই কুঋণ বা মন্দ মানের খেলাপি। এসব খেলাপির  বেশিরভাগই আবার মেজর মান্নান মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের দায়। ঋণ জালিয়াতির কারণে ২০১৬ সালে বিআইএফসি’র পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ২০১৭ সালেই প্রতিষ্ঠানটির অবসায়ন করতে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কোনো অদৃশ্য কারণে সেটি আটকে যায়। বর্তমানে এটি আর্থিক খাতের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে এই প্রতিষ্ঠানে বেশি ক্ষতি হয়েছে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের। ১০ টাকার শেয়ার এখন চার টাকায় নেমে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটির জন্য দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

জানতে চাইলে বিআইএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম আশফাকুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এগুলো সবই মন্দমানের ঋণ হিসেবে আছে। এসব টাকার অংক ৬৪০ কোটি টাকা হলেও সুদে-আসলে তা এক হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে। ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর আদালতের নির্দেশে নতুন বোর্ড দায়িত্ব গ্রহণের পর সাবেক চেয়ারম্যান মেজর আব্দুল মান্নান আমাদের সঙ্গে দুই বার বৈঠক করেছেন। এ সময় টাকাগুলো ফিরিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। তবে এ মুহূর্তে আদালতের নির্দেশে একটি তদন্ত চলমান থাকায় বিষয়টি থেমে আছে। তদন্ত শেষ হলে টাকাগুলো ফেরত দেবেন সাবেক চেয়ারম্যান।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিপুল অঙ্কের এই মন্দ ঋণ আদায়ে তার বিরুদ্ধে ২৭টি মামলা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা এসব মামলার ফল পাইনি। ২০১৫ সাল থেকে শুরু করে পাঁচ থেকে ছয়বার আদালত থেকে স্টে অর্ডার নিয়ে আদায় প্রক্রিয়া থামিয়ে রেখেছেন তিনি। আদালতের নির্দেশে অপর একটি প্রতিষ্ঠান পুরো বিষয়টি তদন্ত করছে। প্রতিষ্ঠানটির নাম ডেলয়টি। যেখানে বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে রয়েছেন নূরুল ফারুক হাসান অ্যান্ড কোং (চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট)।চলতি বছরের অক্টোবরের মধ্যে এই তদন্ত শেষ হতে পারে বলে আশা ব্যক্ত করেন এমডি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০