প্রতিনিধি, রাজশাহী: হিসাব কষে নিজের বয়স এখন ৮৫ বছরের কাছাকাছি হবে বলে জানালেন হাতেম আলী। তিনি ছিলেন ষাট-সত্তর দশকের পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়। হাতেম আলীর দাবি, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ভারতের বিপক্ষে খেলেছেন পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে। স্বাধীনতার পরে ঢাকা মোহামেডান, ঢাকা ওয়ান্ডার্স, ভিক্টোরিয়াসহ বিভিন্ন ক্লাবে খেলেছেন। তবে অদৃষ্টের পরিহাস! শেষ বয়সে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছেন রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর মোড়ে সেদ্ধ ডিম বিক্রি করে। গত ১০ বছর ধরে তিনি ওই স্থানে ডিম বিক্রি করছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বরেন্দ্র জাদুঘরের পাশে হাতেম আলী ও তার স্ত্রী মমতাজ বেগম অল্পকিছু ডিম নিয়ে সেদ্ধ করে বিক্রি করছেন। ওই এলাকায় ‘দাদু’ নামে পরিচিত তিনি। হাতেম আলী জানান, দেশজুড়ে তসলিমা নাসরিনবিরোধী আন্দোলনের সময়ে ১৫ মাস জেলে কাটিয়েছেন। সে সময়েই খেলাধুলায় উপার্জিত টাকা খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে যান। পরে বেছে নেন গবাদিপশুর মাংস ও চামড়া বিক্রির ব্যবসা। ভালোই চলছিল জীবন। ছন্দপতন ঘটে ছেলের মৃত্যুতে। এক ছেলের গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ছেলে হারানোর শোকে ছাড়েন সে পেশা। শুরু করেন সেদ্ধ ডিম বিক্রির ব্যবসা।
হাতেম আলী জানান, ছোটবেলায় খেলার মাঠের বল কুড়াতেন। সেখান থেকে থেকেই শিখেছেন ফুটবল মাঠের নৈপুণ্য। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে ভারতের বিপক্ষে তাদের মাটিতে খেলেছেন একবার। জাতীয় দলের হয়ে গোল পোস্টের অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশ স্বাধীনের পর বিভিন্ন ক্লাবে খেলেছেন। খেলাধুলার ইতি টানেন ১৯৮২ সালে।
বেশিরভাগ সময়েই হাতেম আলীর পাশে থাকেন স্ত্রী মমতাজ বেগম। তিনি জানান, ডিম বিক্রি করে প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৫০ টাকা আয় হয়। পান বয়স্ক ভাতার কিছু টাকা। সেই টাকাতেই সংসার চলে। আগে খেলোয়াড় ভাতা পেলেও দুর্ভাগ্যক্রমে সেটি বন্ধ হয়ে গেছে।
এ সময় নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেন হাতেম আলী। তিনি জানান, মুক্তি সংগ্রামের যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে। রাজশাহী-সংলগ্ন ভারতের শেখপাড়া-কাহারপাড়া ক্যাম্পের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সে সময় অন্যরা মুক্তিযোদ্ধা কার্ড নিলেও তিনি নেননি।
নগরীর হোসেনীগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা হাতেম আলী। আটবার বসেছেন বিয়ের পিড়িতে। বহু বিয়ের কারণ হিসেবে তিনি জানালেন, চারজন মানসিক রোগী, নির্যাতিতা ও দুস্থ নারীকে বিয়ে করে তাদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আট স্ত্রীর সংসারে রয়েছে ১২ ছেলে ও ৯ মেয়ে।
সন্তানদের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা আলাদা হয়ে গেছে। তাদের উপার্জন আমি খেতে চাই না। আমি সৎ পথে, হালাল উপার্জন করে খেতে চাই। এখন আমার পাঁচজনের সংসার। কারও সাহায্য ছাড়ায় চালিয়ে যাচ্ছি।’ তবে সে সময় মুক্তিযোদ্ধার কার্ড না নিলেও এখন আক্ষেপ করেন হাতেম আলী। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও খেলোয়াড় ভাতা পুনরায় চালুর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদনও জানিয়েছেন তিনি।
হাতেম আলীর ব্যাপারে রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ওয়াহেদুন নবী বলেন, ‘তিনি ভালো গোলরক্ষক ছিলেন বলে জানি। জেলা ফুটবল দলের হয়ে খেলেছেন ছয়-সাত বছর। জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই। উনার সমসাময়িক খেলোয়াড়দের কেউই সেটা বলতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু ক্রীড়া ফাউন্ডেশন থেকে তার জন্য ভাতার ব্যবস্থা করতে আবেদন করিয়েছি। আশা করি তিনি পাবেন।’