নিজস্ব প্রতিবেদক: সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল শনিবার সকালে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর বাংলাদেশের গণতন্ত্রে ফেরার প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকারী সাহাবুদ্দীন পরে ১৯৯৬ সালে আবার রাষ্ট্রপ্রধানের পদে ফিরেছিলেন।
২০০১ সালে বঙ্গভবন থেকে বিদায় নেয়ার পর ঢাকার গুলশানের বাড়িতে অনেকটা নিভৃত জীবনযাপন করছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুস্থতায় ভুগছিলেন। মাসখানেক আগে তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। সেখানেই গতকাল শনিবার সকাল সোয়া ১০টায় সাহাবুদ্দীনের মৃত্যু হয় বলে তার জামাতা অধ্যাপক আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তিনি (সাহাবুদ্দীন) আর বেঁচে নেই। সকাল ১০টা ২০ মিনিটে সিএমএইচে মারা গেছেন বলে তার ছোট ছেলে আমাকে জানান।’
দাফনের বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে সময় নির্ধারণ করা হবে বলে জানান তিনি। হাসপাতাল থেকে লাশ গুলশানে প্রেসিডেন্ট কনকর্ডে তার বাড়িতে নেয়া হয়। সেখানে গোসল করানো হয়। বাড়ির ব্যবস্থাপক আবদুল মোতালিব জানান, সাহাবুদ্দীনের দুই ছেলে সিএমএইচেই ছিলেন।
সাহাবুদ্দীনের এক মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এবং এক মেয়ে যুক্তরাজ্যে রয়েছেন। তার পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় ড. সিতারা পারভীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। ২০০৫ সালের ২৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি।
জামাতা অধ্যাপক আহাদুজ্জামান বলেন, রোববার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হতে পারে সাহাবুদ্দীন আহমদকে। সেখানে তার স্ত্রী শায়িত রয়েছেন। দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে ২০১৮ সালে ৮০ বছর বয়সে মারা যান সাহাবুদ্দীন আহমদের স্ত্রী আনোয়ারা আহমদ।
সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোক জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
আজ সকাল ১০টায় জাতীয় ঈদগাহ মাঠে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে বলে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এদিন সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
এদিকে গতকাল বিকালে নেত্রকোণার কেন্দুয়ায় গ্রামের বাড়িতে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। হেলিকপ্টারে করে কফিন নিয়ে যাওয়ার পর জানাজা শেষে আবার ঢাকায় ফেরানো হয় মরদেহ।
নব্বইয়ের আন্দোলনে স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ সরকারের পতনের নাটকীয়তার মধ্যে আকস্মিকভাবে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে আসেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। এরশাদ পদত্যাগ করার পর রাষ্ট্রপতির পদে কে আসবে, নির্বাচন পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কে থাকবেনÑসেই প্রশ্নে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেয়া দলগুলো (তিন জোট) একমত হতে পারছিল না। পরে প্রধান বিচারপতিকে সেই দায়িত্ব দেয়ার বিষয়ে সমঝোতা হয়। আবার সুপ্রিম কোর্টে ফেরার শর্তে সাহাবুদ্দীন আহমদ তাতে রাজি হন।
মওদুদ আহমদ উপ-রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দিলে সেই দায়িত্বে আসেন সাহাবুদ্দীন। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা ছাড়লে সাহাবুদ্দীন হন রাষ্ট্রপতি। পরে তার নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়।
নির্বাচনের পর আবার প্রধান বিচারপতির পদে ফেরেন তিনি। তার সেই ফেরার জন্য দেশের সংবিধানেও পরিবর্তন আনতে হয়েছিল। চাকরির মেয়াদ শেষে ওই পদ থেকেই অবসরে যান তিনি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ দলের প্রার্থী হিসেবে সংসদীয় সরকার পদ্ধতিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সাহাবুদ্দীন আহমদ। ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি সেই দায়িত্বে ছিলেন। তবে ২০০১ সালে নির্বাচনে হারের পর আওয়ামী লীগের সমালোচনার ?মুখে পড়েছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ।
বাংলাদেশের ষষ্ঠ প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের জš§ ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার পেমই গ্রামে। তার বাবার নাম তালুকদার রিসাত আহমদ।
সাহাবুদ্দীন ১৯৪৫ সালে নান্দাইলের চণ্ডীপাশা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৮ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে আইএ পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫১ সালে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৫২ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন তিনি।
১৯৫৪ সালে পাকিস্তানি সিভিল সার্ভিসের (সিএসপি) প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কর্মজীবন শুরু হয় সাহাবুদ্দীনের। ১৯৬০ সালে প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগে বদলি হন তিনি।
১৯৬৭ সালে ঢাকা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পান সাহাবুদ্দীন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। ১৯৮০ সালে আপিল বিভাগে বিচারকের দায়িত্ব পান তিনি। তার এক দশক পরে ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন তিনি।