সাভারের রূপা গ্রাম

গাবতলী হয়ে রাজধানীর সীমানা পেরোতেই ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের গা ঘেঁষে তুরাগ নদের পাড়ে দেশের ঐহিত্যবাহী রুপা গ্রাম। মহাসড়ক ছেড়ে স্টিলের সেতু পার হলেই অলংকার গ্রাম। দু’পাশে সবুজ গাছের বন্ধনীর মাঝে সরু পিচঢালা আঁকাবাঁকা পথ। যেতে চোখে পড়বে ছোট ছোট বাজার। আর একটু উঁকি দিলেই মিলবে সারি সারি অলংকার তৈরির দোকান। এখানে তরুণ থেকে বয়স্ক কারিগরদের হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে নিখুঁত ও বাহারি কারুকাজের নানা অলংকার।
দেড়শ বছরের বেশি সময় ধরে সুবজে ঘেরা এ গ্রামে রুপার গয়না তৈরির কাজে যুক্ত গ্রামবাসী। যদিও সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি; তবে কারিগরদের পূর্বপুরুষের সূত্র ধরে প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাস লুকিয়ে আছে এ রুপা গ্রামের ঘরবাড়ি ও পথ-প্রান্তরে। এক সময় প্রায় পরিবারে জীবিকা নির্বাহে রাজধানীর তাঁতীবাজারে স্বর্ণের কারিগর হিসেবে কাজে যেতেন। সে সময় হঠাৎ স্বর্ণের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেকার হতে শুরু করেন কারিগররা। এছাড়া থাকার ব্যবস্থা ও জীবনযাত্রা কষ্টকর হয়ে পড়ে। ফলে বাধ্য হয়েই ফিরে আসতে শুরু করেন নিজ গ্রামে। শুরু করেন কম পুঁজিতে রুপার গয়না তৈরির কাজ। কম খরচে নান্দনিক কাজের অলংকার তৈরিতে ক্রেতার কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পান তারা। সাভার উপজেলার ভাকুর্তা গ্রামটি এভাবেই রুপা গ্রামে বদলে যায়। দেশজুড়ে রুপা গ্রামের বেশ জনপ্রিয় ও পরিচিতি ফুটে ওঠে। শুধু দেশ নয়, বিদেশ থেকেও অনেকে ক্রেতা ভিড় জমাতেন এখাকার তৈরি অলংকারের জন্য। সীতা হার, কানের দুল, হাতের বালা সবই যেন মেলে এ গ্রামটিতে। গ্রামের প্রায় পরিবারের নারী-পুরুষ গয়না তৈরির কাজ করেন।
সুখ্যাতি থাকলেও রুপা গ্রামের সেই জৌলুস যেন হারানোর পথে। রুপার বদলে দখল করেছে তামা-পিতলের গয়না। কালের বিবর্তনে এখানকার ঐতিহ্য ও ইতিহাস এখন অনেকটাই বিলীন। ঐতিহ্যের ইতিহাস থাকলেও বাস্তবতায় অনেকাই এখন বিলীনের পথে। যুগের চাহিদায় রুপার বদলে তামা ও পিতলের তৈরি গয়না দখল করেছে চাহিদার বাজার। গত এক দশকে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। জীবিকার তাগিদে অনিচ্ছায় হলেও কারিগররা রুপার গয়না তৈরি প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। এক সময় এ বাজারে তিন শতাধিক দোকান থাকলেও কমে এখন আছে তার অর্ধেক। দু-একটি ছাড়া রুপার গয়না তৈরি হয় না বললেই চলে। এমনকি দীর্ঘ সময় পার হলেও ভাগ্য বদলায়নি গয়না তৈরির কাজে জড়িত পরিবারগুলোর। দু-চারটি ইটের ভবনের দেখা মিললেও প্রায় ঘরবাড়ি এখনও জরাজীর্ণ।
শামসুর নাহার নামে এক ক্রেতা জানান, রুপার দামের চেয়ে তামা-পিতলের গয়নার দাম কম। ফলে নষ্ট হয়ে গেলেও আরেকটি সহজেই কেনা যায়। পাশাপাশি দামি অলংকার পরলে নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টিও কাজ করে। সেদিক থেকেও অনেকটা নিরাপদ থাকা যায়।
দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে খুচরা
ব্যবসায়ীরা জানান, দিন দিন তামা-পিতলের গয়নার চাহিদা বাড়ছে। ফলে স্বর্ণ ও রুপার অলংকারের পাশাপাশি দোকানে এখন
তামা-পিতলের অলংকারও গুরুত্ব পাচ্ছে। তাই এখান থেকে পাইকারি কিনতে আসা। আবার ক্রেতার চাহিদা অনুসারে ডিজাইন দিয়েও অলংকার তৈরি করে নিই।
রুপা গ্রামের অলংকার তৈরির কারিগর আলমগীর কবির জানান, সময়ের ব্যবধান আর ক্রেতার চাহিদার কারণেই ব্যবসায়ীরা উপকরণ বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। খরচের পাশাপাশি অসাধু ব্যবসায়ীর প্রতারণা থেকে বাঁচতে ক্রেতার কাছে রুপার বদলে দখল করে নিয়েছে
তামা-পিতল। এখন কারিগররা আগের মতো মূল্যায়ন ও পারিশ্রমিক কোনোটাই পান না। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকে পেশা পরিবর্তন করছেন। আরেক অলংকার কারিগর ও ব্যবসায়ী জানান, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অলংকার দোকানে রুপার অলংকারের চেয়ে তামা-পিতলের গয়না সাজিয়ে রাখেন। কোনো ক্রেতা রুপার গয়না চাইলেও দোকানি কৌশলে বুঝিয়ে তামা-পিতল তুলে দিচ্ছেন তাদের হাতে। কারণ রুপার ভরির নির্দিষ্ট দাম আছে, তামা-পিতলের নেই। সেক্ষেত্রে তামা-পিতলের অলংকার বিক্রিতে লাভ বেশি। এক্ষেত্রে ক্রেতা প্রতারিত হচ্ছেন।
সাভারের ভাকুর্তা গ্রামের জুয়েলারি সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক দুলাল রাজবংশী জানান, কয়েক দশক আগে ভারত থেকে কম দামে সিটিগোল্ড নামে স্বর্ণের রঙের আদলে তামা-পিতলের অলংকারের প্রচলন শুরু হয়। সে থেকেই মূলত রুপার গয়নার চাহিদা কমতে শুরু করে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে আমাদের মতো ব্যবসায়ী ও কারিগররাও তামা-পিতলের গয়না তৈরি শুরু করেন। তবে তামা-পিতলের গয়নায় চর্মরোগ থেকে শুরু করে নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া তামা-পিতলের গয়না পুনরায় বিক্রি করা যায় না। কিন্তু রুপার দাম পাওয়া যায়। ক্রেতারাই পারেন রুপার জৌলুস ও গ্রামের ঐহিত্য বাঁচিয়ে রাখতে। পাশাপাশি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতার কথা জানান তিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. অসিত বরণ পাল জানান, আগের তুলনায় রুপা গ্রামের অনেক দোকান কমে গেছে। তবে দেশের এ রকম ঐহিত্য টিকিয়ে রাখতে সাধারণ ক্রেতার পাশাপাশি সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলকেও এগিয়ে আসতে হবে।

জাহিদ হাসান শাকিল

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০