Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 7:03 pm

সামাজিক ব্যাধি যৌতুক: প্রসঙ্গ আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতা

স্বপ্না চক্রবর্তী: রাজধানীর তেজগাঁওয়ে একটি গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করতেন লালমনিরহাটের আফরোজা বেগম ও রহিমুদ্দিন দম্পতি। এক মেয়ে, এক ছেলের মা আফরোজা ঘরসংসারের সঙ্গে সঙ্গে কারখানার কাজেও ছিলেন দক্ষ। ফলে কাজের জায়গায় উত্তরোত্তর উন্নতিও করছিলেন তিনি নিয়মমতো। কিন্তু আঘাত হানল করোনা। দিনের পর দিন লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মালিকপক্ষ কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে দেয়। এতে করে কর্মহীন হয়ে পড়েন দুজনেই। লকডাউনে ঘরবন্দি দুজনেই বেকার। লকডাউন খুললে মাঝে কয়েকদিন রিকশা চালিয়ে সংসারের খরচ মেটানোর চেষ্টা করেন রহিমুদ্দিন। কিন্তু অল্পদিনেই বুঝে যান কারখানার কাজের আরাম রিকশা চালানোর মধ্যে নেই। এবার বের হয় তার আসল রূপ। স্ত্রী যদি ঘরে বসে থাকে তাহলে সে বাইরে পরিশ্রম করবে কেন? বাসায় বাসায় ছুটা বুয়ার কাজে পাঠানো শুরু করে দেয় আফরোজাকে। ঘরে বেকার বসে থেকে রহিমুদ্দিনের হয়েছে জুয়া খেলার নেশা। মগবাজারের মধুবাগ বস্তির বাসিন্দা রহিমুদ্দিনের দিনের বেশিরভাগ সময়ই কাটে এখন জুয়া খেলায়। মাস শেষে বাসাবাড়ির কাজ করে আনা স্ত্রীর বেতনের টাকাগুলো সব নিয়েও তুষ্টি নেই তার। নিজের রিকশা কিনবে, তবেই নামবে রোজগারেÑএই তার শেষ কথা। কিন্তু এর জন্য টাকার জোগাড়টা আফরোজা বেগমকেই করতে হবে। বাসাবাড়ির কাজ করে কি আর একসঙ্গে এত টাকা জোগাড় করা আফরোজার পক্ষে সম্ভব? নতুন করে ফন্দি বের করেন এবার রহিমুদ্দিন। বিয়ের সময় বাকি থাকা যৌতুকের ৩০ হাজার টাকা আফরোজাকে তার বাবার কাছ থেকে এনে দেয়ার বায়না শুরু করে দেন। দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বায়না আর বায়নাতে সীমাবদ্ধ না থেকে রূপ নিতে থাকে নির্যাতনে। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত যৌতুকের টাকার জন্য গায়ে হাততোলা থেকে শুরু করে এমন কোনো নির্যাতন নেই, যা আফরোজা বেগমকে সহ্য করতে হয় না। নির্যাতন সহ্য না করতে পেরে কয়েকবার আত্মহত্যারও চেষ্টা করেন তিনি।

যৌতুকের এ চিত্র বস্তির হলেও ভয়াবহ এ চিত্র বন্ধ নেই ফ্ল্যাট-বাড়িতে থাকা নারীদের জীবনেও। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যৌতুকের জন্য চিকিৎসক স্বামীর বিরুদ্ধে লাইভ করে আলোচনায় আসেন এলেনা রামিসা নামের এক তরুণী। ভালোবেসে বিয়ে করলেও এক মাসের মাথায়ই চেম্বার করার নাম করে যৌতুক দাবি করে স্বামী ও তার পরিবার। চাহিদামতো বাবার বাড়ি থেকে যৌতুক এনে দিতে না পারায় শাশুড়ি-ননদসহ শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হতে হয় স্বামীর হাতেও।

আফরোজা বা রামিসা নয়, আবহমানকাল ধরেই যৌতুকের দাবিতে বাংলার মেয়েদের নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সরকারের বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তরের যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফলতা সে অর্থে আসছেই না। সামাজিক এই ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। গ্রাম থেকে শহরে, উচ্চবিত্ত থেকে নি¤œবিত্ত সব জায়গায়ই এই ব্যাধির প্রকোপ বাড়ছেই দিন দিন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪ জন নারী। হত্যা করা হয়েছে আরও ২ জনকে। একইভাবে ফেব্রুয়ারিতে নির্যাতনের শিকার হন ৪ জন। হত্যার শিকার হন ৫ জন নারী। এর পরের মাসে অর্থাৎ মার্চে ১১ জন নারীকে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন করা হয়। এ সময় হত্যা করা হয় ৯ জনকে। এপ্রিল মাসে নির্যাতনের শিকার হন ১০ নারী এবং নির্যাতনের কারণে মৃত্যু হয় ৬ জনের। মে মাসে নির্যাতিত হন ৬ জন। একই সময় মৃত্যু হয় ৩ জন নারীর। জুন মাসে নির্যাতিত হন ৯ জন নারী। এ সময় হত্যা করা হয় ৫ জনকে। জুলাই মাসে নির্যাতনের শিকার হন ৭ জন নারী। মৃত্যু হয় ২ জনের। পর্যায়ক্রমে আগস্টে নির্যাতনের শিকার হন ৭ জন। মৃত্যু হয় আরও ১ জনের। তবে সেপ্টেম্বরে এ চিত্র ভয়াবহ রূপ নেয়। শুধু সেপ্টেম্বরে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতিত হন ১৬ জন নারী। হত্যা করা হয় ৫ জনকে। শুধু চলতি বছরই নয়, যৌতুকের দাবিতে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৫ জন নারী নির্যাতনের শিকার এবং ৫২ জন নারী হত্যার শিকার হন বলে মহিলা পরিষদের প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।

প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনের আধুনিকতার ছোঁয়া প্রবেশ করেছে আরও আগেই। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক কালের এই নির্যাতনের চিত্রের কোনো পরিবর্তন নেই। দেশ থেকে যৌতুকপ্রথা দূর করতে বাংলাদেশের সরকার ১৯৮০ সালে যৌতুক নিরোধ আইন প্রণয়ন করেছিল। ওই আইনে বলা হয়েছিল, যৌতুক গ্রহণকারী ও যৌতুক প্রদানকারী উভয়ই সমান অপরাধী। তারা উভয়েই সর্বোচ্চ এক বছর মেয়াদের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

৩৮ বছর আগে আইনটি প্রণীত হলেও এ আইনের প্রয়োগ খুব একটা দেখা যায়নি। বরং যৌতুক আদান-প্রদান হয়েছে এবং এখনও হচ্ছেÑকখনও সরাসরি, কখনও বা অন্যভাবে। বরপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী কনেপক্ষ যৌতুক দিয়েই গেছে। আর যৌতুক না দেয়ায় কত নারী যে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কত নারীর সংসার ভেঙেছে, আর কত নারী যে খুন হয়েছেন, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু যৌতুক চাওয়ার জন্য কারও শাস্তি হয়েছে, এমনটা খুব কমই দেখা গেছে।

তবে সরকার সম্প্রতি যৌতুক আদান-প্রদান প্রতিরোধে ১৯৮০ সালের আইনটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। ২০১৮ সালের মে মাসে ‘যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। নতুন আইনে শাস্তির মেয়াদ ও জরিমানার পরিমাণ দুটিই বাড়ানো হয়েছে। নতুন আইনে বলা হয়েছে, কেউ যৌতুক দাবি করলে তিনি পাঁচ বছরের জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আইনের পাঁচ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য কেউ যদি যৌতুকসংক্রান্ত মিথ্যা মামলা দায়ের করেন, তারও সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেল থেকে সর্বনি¤œ এক বছরের জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধ আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য হবে, তবে আপসযোগ্য হবে।

কনের পরিবার কর্তৃক বর বা তার পরিবারকে প্রদত্ত হস্তান্তরিত সম্পদ হলো যৌতুক। অন্যভাবে যৌতুক হলো নববধূর নির্দিষ্ট সম্পত্তি, যা বিয়ের সময় বরের মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণে থাকে। সাধারণ অর্থে যৌতুক বলতে বিয়ের সময় বরকে কনের অভিভাবক কর্তৃক প্রদেয় অর্থ বা মূল্যবান সামগ্রীকে বুঝায়। এছাড়া বর-কনের আত্মীয়, অভ্যাগত অতিথিরাও সাধারণত স্বেচ্ছায় নবদম্পতিকে দিয়ে থাকেন, যা তারা তাদের নতুন সংসারে সুবিধামতো ব্যবহার করতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারীর ক্ষমতায়ন বা বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে গেলেও আগে দরকার যৌতুকপ্রথা বন্ধ করা। তবে শুধু যারা যৌতুক নিচ্ছে, তারা নয়। যারা দিচ্ছে, তারাও অপরাধী। তাদের মতে, যৌতুক প্রথা কমেনি তো বটেই, উল্টো এটি যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। একসময় এটা একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন এটা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত সবার মধ্যেই এটা ছড়িয়ে আছে। সব ধর্ম-বর্ণের মধ্যে এই যৌতুক প্রথা এখনও আসন গেড়ে বসে আছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক রিপোর্টে দেখা যায়, দেশের ৮৭ ভাগ মেয়ে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এর সিংহভাগই হচ্ছে যৌতুকের কারণে। বিয়ের ১০ বছর পরও যৌতুকের কারণে মেয়েদের নির্যাতন করা হচ্ছে, তার পরিবারের ওপর চাপ দেয়া হচ্ছে। এটা বন্ধ করা না গেলে নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্যবিয়ে বন্ধ বা মেয়েদের সম্মানজনক অবস্থায় কখনও নিয়ে যাওয়া যাবে না।

যৌতুকের ধরন গ্রাম এবং শহর ভেদে ভিন্ন। গ্রামের বিষয়গুলো দৃশ্যমান। সেখানে এখনও এটা প্রচলিত আছে যে, যৌতুক না দিলে মেয়ের বিয়ে হবে না। বয়স বেশি হলে যৌতুক বেশি দিতে হবে। মেয়ে কালো হলে যৌতুক ছাড়া বিয়ে দেয়া যাবে না। মেয়ের শারীরিক কোনো ত্রুটি মানেই যৌতুক নিশ্চিত। এসব প্রতিবন্ধকতা যুগের পর যুগ একই রকম চললেও সম্প্রতি শহরে চলছে যৌতুকের নানা ‘ফরম্যাট’। এখানে উচ্চবিত্তরা চাকরি, গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংক নানা কায়দায় এটা চালাচ্ছে। যারা দিচ্ছে এবং নিচ্ছে, তাদের সামাজিকভাবে বয়কট না করলে এর থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় নেই।

সমাজের এই মারাত্মক ব্যাধিটি বন্ধে সর্বপ্রথম আইনের সংশোধন প্রয়োজন। তবে আইনের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতাও অত্যন্ত জরুরি। যারাই যৌতুক দিচ্ছে বা নিচ্ছে দুজনই সমান অপরাধী। তাদের বয়কট করলে এই ব্যাধিটা অনেকটাই সেরে উঠবে। এর জন্য প্রয়োজন প্রচার-প্রচারণা, কর্মশালা, সেমিনার। এসবের মাধ্যমে এটা যে একটা ব্যাধি, তা মানুষকে বোঝাতে হবে। তাহলেই যৌতুক না দিতে পেরে আর কোনো মা-বাবাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হবে না। কোনো মেয়েকেও আর পোহাতে হবে না মৃত্যু যন্ত্রণা।

পিআইডি নিবন্ধ