Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 4:10 pm

সামাজিক মানুষ এবং সামাজিকীকরণের প্রভাব

মোঃ সুমন ইসলাম: মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে জন্ম নেয় না। সমাজই ধীরে ধীরে তাকে সামাজিক জীবে পরিণত করে। আর মানুষকে সামাজিক জীব হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সমাজের যে উপাদান কাজ করে তা হলো সামাজিকীকরণ। সামাজিকীকরণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একজন মানুষ সমাজের বসবাসের উপযোগী হয়ে ওঠে। সামাজিকীকরণই একজন মানুষকে পূর্ণাঙ্গ সামাজিক মানুষে পরিণত করে। সামাজিকীকরণের বিভিন্ন মাধ্যম গুলোর মধ্যে- পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সঙ্গীদল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বই ও পত্র-পত্রিকা এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিহার্য।

পরিবার হলো একজন মানুষের শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সামাজিকীকরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। পরিবার থেকেই একটি শিশু ধীরে ধীরে তার ব্যক্তিত্ব গঠনের পথে অগ্রসর হয়। এক্ষেত্রে পারিবারিক পরিবেশে একজন শিশু প্রাথমিক পর্যায়ে তার শিষ্টাচার, মূল্যবোধ, নীতিনৈতিকতাবোধ এবং প্রথা ও রীতিনীতি শিক্ষা পেয়ে থাকে। যা তার ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পরিবারের পরে একজন শিশুর সামাজিকীকরণে অন্যতম ভূমিকা রাখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সঙ্গীদল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সামাজিকীকরণে ভূমিকা রাখলেও সঙ্গীদল এক্ষেত্রে বেশি ভূমিকা পালন করে। আর সঙ্গীদলের মধ্যে সহপাঠী এবং সমবয়সী বন্ধুবান্ধবদের ভূমিকা অপরিহার্য। একজন শিশু পরিবারের পরে তার সহপাঠী এবং সমবয়সী বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করে যার ফলে তার ব্যক্তিত্ব গঠনের ক্ষেত্রে এদের অবদান অনস্বীকার্য। একজন ভালো সহপাঠী এবং সমবয়সী বন্ধুবান্ধব যেমন শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে ভালো প্রভাব বিস্তার করতে পারে তেমনই একজন খারাপ সঙ্গী তার ব্যক্তিত্বে বিরূপ প্রতিক্রিয়া রাখতে পারে। সেক্ষেত্রে শিশুরা যেহেতু তাদের ক্ষুদ্র জ্ঞান এবং বিবেকবোধ দ্বারা ভালোমন্দ বাচবিচার করতে পারে না সেহেতু পরিবারের সদস্যদের উচিৎ শিশুদের ভালো সঙ্গী নির্বাচনে সহায়তা করা। যা পরবর্তী সময়ে তার ব্যক্তিত্ব গঠনের পথে সচেষ্ট ভূমিকা রাখবে।

একজন শিশু যেমন খারাপ হয়ে জন্ম নেয় না তেমনই ভালো হয়েও জন্ম নেয় না। শিশু জন্মের পর সমাজই ধীরে ধীরে তাকে ভালোমন্দের দিকে ঠেলে দেয়। একজন শিশু ভালো হবে না মন্দ হবে সেটা তার পারিবারিক শিক্ষা থেকে যেমন পায় তেমনই সঙ্গীসাথীদের মাধ্যমেও পায়। এক্ষেত্রে আবার দেখা যায় পরিবার ভালো শিক্ষা দিলেও খারাপ সঙ্গীদলের পাল্লায় পড়ে সে ধীরে ধীরে খারাপের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যা এক পর্যায়ে তাকে সামাজিক বোধবুদ্ধি থেকে দূরে রাখে। একটা সময় সে তার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ভয়ংকর খারাপের দিকে এগোয়।

বর্তমানে তরুণদের মধ্যে যে সামাজিক বোধহীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তার অন্যতম কারণ হলো সঠিক সামাজিকীকরণের অভাব। সুষ্ঠু ও সুন্দর সামাজিকীকরণের অভাবে তরুণদের মধ্যে নানা ধরনের নীতিনৈতিকতাহীন এবং অপরাধমূলক কর্মকা্লের বিস্তার ঘটছে। একজন শিশু (৬-১৭ বছর বয়সী) অসৎসঙ্গে পড়ে ধীরে ধীরে খারাপের দিকে এগোয়। খারাপ সঙ্গীদল প্রথমে তাঁর ব্রেনওয়াশ করে তাকে মাদকে আসক্ত করে তোলে। তারপর সেই মাদকই তাকে ধীরে ধীরে কিশোর অপরাধ থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে খুনখারাবি, রাহাজানি, সন্ত্রাস, চোরাকারবারি এমনকি নানা প্রকার গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে ফেলে। যা থেকে চাইলেও পরবর্তী সময়ে আর বের হতে পারে না। ফলে সে পুরোপুরি অপরাধ জগতে ঢুকে পড়ে। আবার অনেক সময় দেখা যায় এসব শিশু-কিশোররা একত্রিত হয়ে একটি গ্যাং করে বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত করে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় ২০২০-২০২৩ সালের মধ্যে কিশোর গ্যাং অপরাধ বেড়েছে। পুলিশ হিসাব অনুযায়ী এসময়ে ৩২৫ টির অধিক মামলা দায়ের হয়েছে শুধু কিশোর গ্যাং অপরাধের জন্য। এসব মামলায় ৯০০ এর অধিক আসামী করা হয়েছে। দিন দিন এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা একটি সমাজ ও দেশের জন্য অশনী সংকেত।

ইউনিসেফ এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ। সেই হিসেবে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ তরুণ জনগোষ্ঠী। দিন দিন যথাযথ সামাজিকীকরণের অভাবে যে হারে কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে এই বিপুল সংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠী হুমকির মুখে পতিত হবে। বিশ্লেষকদের মতে খেলার মাঠের স্বল্পতা, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, অসৎসঙ্গ ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে কিশোর ও যুব বয়সীরা নানা রকম অপরাধ মূলক কর্মকা্লে জড়িয়ে পড়ছে। তাই শিশু-কিশোরদের এসব অপরাধ মূলক কর্মকা্ল থেকে বিরত রাখতে হলে প্রয়োজন সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ। শৈশবকাল থেকেই একজন শিশুকে সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে যথাযথ সামাজিকীকরণ অপরিহার্য। সেই সাথে পরিবার, সমাজ, ধর্ম ও বন্ধ-বান্ধব এসব তরুণদের অপরাধ মূলক কর্মকা্ল থেকে দূরে রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। আধুনিক বিশ্বে বিশ্বায়ন ও তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ শিশুর সামাজিকীকরণে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। তাই সময়ের সাথে তরুণ-যুবাদের নতুন নতুন প্রযুক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে এর সুফল ও কুফল গুলো সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। পরিবার ও সমাজ থেকে শিশুকাল থেকেই যথাযথ ধর্মীয় ও নীতিনৈতিকতা এবং মূল্যবোধের শিক্ষা প্রদান করতে হবে। সর্বপরি তরুণ জনগোষ্ঠীকে যথাযথ সামাজিকীকরণের আওতায় আনতে হবে। যেহেতু সামাজিকীকরণ একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া, সারাজীবন এ প্রক্রিয়া চলমান থাকে। একমাত্র মৃত্যুর মধ্য দিয়েই মানবজীবনে সামাজিকীকরণের পরিসমাপ্তি ঘটে।
সুতরাং একজন শিশুকে যথাযথ সামাজিক মানুষে পরিণত করতে হলে সামাজিকীকরণের সুদূরপ্রসারী প্রভাব অপরিসীম।