সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়

 

ইসরাত জাহান: আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক কৃষ্টি, সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও অনুশাসনের অবক্ষয় দিন দিন বেড়ে উঠছে। মানুষের সভ্যতার উপকরণগুলো যেন খসে পড়ছে, ভেঙে পড়ছে সামাজিক শৃঙ্খল, তরুণ সমাজ বিপথগামী হচ্ছে। তরুণদের মধ্যে মাদকাসক্তি, লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির নেশা, বখাটে, উগ্রতা লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে চলছে। সমাজের অভিভাবক শ্রেণিকে শ্রদ্ধা এবং তোয়াক্কা করে না এই তরুণরা। অভিভাবক শ্রেণিও তাদের এই ঔদ্ধত্য দেখে চুপ হয়ে থাকে। শাসন-বারণ করার ইচ্ছে পোষণ করেন না; কারণ শাসন করতে গেলে যদি ওই তরুণ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ কিংবা অসম্মান করে বসে তাছাড়া এখনকার উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা গুরুজনদের গায়ে হাত উঠাতেও দ্বিধাবোধ করে না। এর ফলে যা হচ্ছে, এদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পুলিশকে ছুটে আসতে হচ্ছে। অথচ আগে এ কাজটি সমাজের অভিভাবকরাই করতেন।  আমাদের পরিবার ও সমাজের মূল্যবোধের অবনমন এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে। যেসব সামাজিক ও পারিবারিক অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে, এগুলোকে এখন আর বিচ্ছিন্ন বলে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। একের পর এক অকল্পনীয় ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে, আমরা কি দিন দিন স্বার্থপর ও বর্বরতার দিকে ধাবিত হচ্ছি? এর কারণ কি? এর প্রধান কারণ যদি ধরা হয় অর্থ এবং এ নিয়ে প্রতিযোগিতা ও এর প্রতি প্রবল আকর্ষণ, তবে এ কথাও বলা যায়, আমাদের দেশের মানুষ যুগ যুগ ধরেই অর্থের টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল, সে সময়ও মানুষ তার নৈতিক চরিত্র হারায়নি। অভাবের মধ্যেও তার নীতি-নৈতিকতা দৃঢ় ছিল। এখন সমাজে মান-সম্মান ও ইজ্জতকে তোয়াক্কা করার প্রবণতা কমে গেছে। অনেকের মধ্যে এমন প্রবণতা বিরাজমান, ভালো মানুষ না হলেও অর্থ-বিত্তের মালিক হতে পারলে মান-সম্মান জুগিয়ে নেয়া যায়। এর নজিরও কম নয়। দেখা যায়, দুর্নীতিগ্রস্ত ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীর একটি অংশ সমাজের নিয়ন্তা হয়ে বসে আছে। তাদের অর্থ আছে, গায়ের জোরও আছে। তারা মনে করে, এই দুই শক্তি থাকলে মান-সম্মান এমনিতেই তাদের পায়ে লুটিয়ে পড়বে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, আমরা সম্মিলিতভাবেই এদের অবস্থানকে শক্ত করার সুযোগ করে দিচ্ছি। আমাদের মধ্যে যাদের এখনও সুকুমারবৃত্তি রয়েছে, তারা যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসী হয়ে বসবাস করছি। কে মরল আর কে মারল, এ নিয়ে টু শব্দ করি না। কীভাবে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে হয়, তা জেনেও উদ্যোগী হই না। আমাদের দুর্বলতার এ সুযোগটাই নিচ্ছে সমাজের মাথা হয়ে থাকা দুষ্টচক্র। শুধু সমাজের এই দুষ্টচক্র নয়, রাজনীতি থেকে রাষ্ট্র পরিচালকরাও এ সুযোগ নিচ্ছে। তারা আমাদের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। এ সময়ে খুব বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ কথাটি। সত্যিকার অর্থেই আমরা একটা ভয়ের পরিবেশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যেখানে উচিত কথা বললে অনেক সময় হেনস্থার শিকার হতে হয়। যারা এ কাজটি করে এজন্য যে, হুমকি-ধমকি দিয়ে ভীতি সৃষ্টি করতে না পারলে তাদের দুষ্কর্মের রাজত্ব কায়েম করা যাবে না।

আমাদের নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অধঃপতনের যে কথা এখন উঠছে, এর মূল কারণ হচ্ছে, অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো একটি হাইপথিটিক্যাল কথা বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মূল চেতনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধকে মূল্যায়ন না করে হেয় প্রতিপন্ন করা এবং একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর অসাম্প্রদায়িকতার কথাকে প্রাধান্য দেয়া। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনোজগতে এক ধরনের পরিবর্তন এবং অস্থিরতা ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। তা না হলে মা কর্তৃক সন্তান, সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতা হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হবে কেন? যদি এসব ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের ধর্মীয় মূল্যবোধ বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট থাকত, তাহলে এ ধরনের অকল্পনীয় ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পেত না। এখন রাষ্ট্র পরিচালকদের পক্ষ থেকেই বলা হয়, বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। অথচ এ দুটো শব্দের অর্থ সাধারণ মানুষের কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। যারা বুঝতে সক্ষম, তাদের মধ্যে এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, ধর্ম নিরপেক্ষ মানে কি এই যে, কেউ ধর্মপালন করবে না? আবার এই প্রশ্নও আসতে পারে, ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে যদি প্রত্যেক ধর্মের মানুষ পারস্পরিক সহবস্থানে থেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করা বোঝায়, তাহলে বাংলাদেশে কি এই পরিস্থিতি নেই? রাষ্ট্র পরিচালনায় যারাই থাকুক না কেন, তাদের ধর্মের প্রতিফলন কি তাদের কর্মের ওপর প্রভাব ফেলে না? যদি তা না হয়, তাহলে তো তাদের কর্মে সব ধর্মেরই প্রতিফলন থাকতে হবে। এটা কি সম্ভব? অথচ স্বাভাবিক নিয়মই হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষেই রাষ্ট্র পরিচালকদের থাকতে হয়। সারাবিশ্ব এ নিয়মেই চলছে। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা ভারতেও তার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের ভিত্তিতেই পরিচালিত হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের ভোটেই তারা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। ইউরোপ-আমেরিকাসহ সারাবিশ্বে তাই হচ্ছে। আমাদের দেশেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ভোটেই সরকার নির্বাচিত হয়। কাজেই এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসের কথা না বলে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত? এটা কি বাস্তবতাকে অস্বীকার করা নয়? সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মূল্যবোধ ও বিশ্বাস যখন রাষ্ট্র পরিচালকদের পক্ষ থেকে উপেক্ষিত হয়, তখন এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পুরো সমাজে পড়তে বাধ্য। সমাজে একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক। বরং চাপিয়ে দেয়ার মতো কোনো ধরনের উদ্ভট মতবাদ নিয়ে কথা না বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিরায়ত বৈশিষ্ট্য ও মূল্যবোধকে উজ্জীবিত করতে পারলেই সমাজ থেকে অস্বাভাবিক ঘটনা কমে যাবে।

শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০