সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার

শাহরিয়ার হাসান রাকিব: আমাদের দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে  ফেসবুকের অবস্থান শীর্ষে। ফেসবুক ছাড়া অনেকেরই এক দিনও কাটানো একপ্রকার দুঃসাধ্য। কিন্তু অতিমাত্রায় ফেসবুকের ব্যবহারে অস্থিরতা বেড়েছে বলেই ধারণা।

ফেসবুকের উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিশ্বকে উম্মুক্ত এবং সংযুক্ত করা। এর অনেকটাই বাস্তবায়িত। ফেসবুকের বদৌলতে  ব্যবহারকারীরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে পছন্দের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন। কিন্তু এসব সুবিধার আড়ালে বাস্তব জগৎ থেকে সরে ভার্চুয়াল জগতে অনুপ্রবেশ করে জীবনের মূল্যবান সময় অপচয় হচ্ছে।

ব্যবহারকারীদের অনেকে ফেসবুক আবিষ্কারের ইতিহাস জানেন। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন মার্ক জাকারবার্গ ও তার কয়েক বন্ধুর সহযোগিতায় ফেসবুক তৈরি করেন। এর সদস্য প্রাথমিকভাবে হার্ভার্ড ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু পরে সেটা বোস্টন শহরের অন্যান্য কলেজ, আইভি লিগ এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। পরে এটা সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, হাইস্কুল এবং ১৩ বছর বা ততধিক বয়সীদের জন্য  উš§ুক্ত করা হয়। ফেসবুক আবিষ্কারের শুরুর দিকে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা হাতেগোনা কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল কিন্তু বর্তমানে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৯১ কোটি। অর্থাৎ বিশ্বের ৩৬.৯ শতাংশ মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে। এ সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।

প্রশ্ন হলো, ফেসবুক কেন এত বেশি ব্যবহার করা হয় এটি ব্যবহারকারীদের কী ধরনের প্রশান্তি দেয় বা  তারা এর দ্বারা কতটা উপকৃত হয় এর উত্তর হলো, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা যেমন: লাইক এবং ইতিবাচক অনুভূতির প্রদান করে মস্তিষ্কের পুরস্কার কেন্দ্রকে  সক্রিয় করে। অর্থাৎ এটি আমাদের তাৎক্ষণিক তৃপ্তি দিয়ে থাকে। এ ছাড়া বন্ধুদের যুক্ত করতে পারে, স্বাধীনতার অনুভূতি প্রদান করে, একাকিত্ব থেকে মুক্তি দেয়, বিখ্যাত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করা প্রভৃতি।

মূলত কী কী বিষয় নিয়ে ব্যবহারকারীরা ফেসবুকে সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। অধিকাংশ সময় বিভিন্ন ছবি শেয়ার করি, অনুভূতি শেয়ার করেন, বিভিন্ন প্রাপ্তি শেয়ার করে এবং অন্যের লাইক, কমেন্ট, শেয়ার এগুলো প্রত্যাশা করেন। যখনই কেউ ছবিতে বা পোস্টে লাইক বা পজিটিভ কমেন্ট করছে, এটা  ক্ষণস্থায়ী তৃপ্তি তৈরি করে। সব মানুষের মোটামুটি নিজের সম্পর্কে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা করে, তাই ফেসবুকের বদৌলতে এটা যেহেতু সম্ভব হচ্ছে, তাই এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

ফেসবুক কর্তৃপক্ষের আয়ের বড় অংশ আসে বিজ্ঞাপন থেকে। সাধারণত ফেসবুক বিজ্ঞাপনগুলোর জন্য প্রতি ক্লিকে ৫০ সেন্ট থেকে ২ ডলার খরচ হতে পারে।

ছোট শিশু, যুবক থেকে শুরু করে প্রবীণ ব্যক্তি পর্যন্ত ফেসবুক ব্যবহার করছে। শিশু-কিশোরদের  উদ্দেশ্যে ফেসবুক বিভিন্ন ভিডিও তৈরি করছে। তরুণের ছবি আপলোড করে, পোস্ট করছে, চ্যাট করছে প্রভৃতি অন্যদিকে বয়োবৃদ্ধরা ফেসবুকের বদৌলতে পরিচিত কিংবা সমবয়সীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন,  একাকিত্ব দূর করার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। মোট কথা, সব শ্রেণির মানুষের আনন্দ উপভোগের কথা মাথায় রেখে ফেসবুক নিত্যনতুন বিষয়বস্তু সংযোজন করছে।

ফেসবুকের নেতিবাচক প্রভাবও কম নয়। একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ অনেকটা অনলাইন জীবনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন কার্য সম্পাদনের জন্য অফিসিয়াল কাজগুলোর তথাকথিত হাতের কাজের ওপর নির্ভরশীল নয়, কম্পিউটারে এসে এই বাড়তি কাজের চাপ কমিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। কাজের জন্য এখন অনলাইনের বিকল্প নেই, তেমনি একটি নির্দিষ্ট লেভেল পর্যন্ত ফেসবুক ব্যবহার করা ভালো। ফলে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো বিষয় সম্পর্কে অবহিত হতে পারি কিন্তু এটা মনে রাখা জরুরি যে, মাত্রাতিরিক্ত ফেসবুক ব্যবহার কোনোভাবেই কাম্য নয়।

কিছু নেতিবাচক প্রভাব হলো

কোনো কাজে ভালোভাবে মনোযোগ দিতে বিঘœ ঘটায়। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যেমন: হতাশা, অস্থিরতা, একাকিত্ব, নিজের ক্ষতি সাধন এবং মাঝে মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা তৈরি করে। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। সাইবার বুলিংয়ের মাধ্যমে অন্যকে বিরক্ত করা হয়। গোপনীয়তার ওপর হস্তক্ষেপ হতে পারে। বিভিন্ন আক্রমণাত্মক ছবি এবং মেসেজ শিশুরা ফেসবুক থেকে দেখতে পারে, যা তাদের বৃদ্ধিতে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। কেউ গুজব ছড়ায়। শিক্ষার্থীদের একাডেমিক দক্ষতার উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে অসুস্থতা থেকে মুক্তির জন্য ড্রাগ সেবন করা হয়ে থাকে। অনেক সময় ওই নির্দিষ্ট ড্রাগের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পয়ে অর্থাৎ ড্রাগটি ব্যবহার না করলে বিভিন্ন অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যায়, তেমনি ফেসবুক আসক্তির পরে ফেসবুক ব্যবহার না করলে ব্যতিক্রমী কিছু আচরণের উদ্ভব ঘটে। উদাহরণ হিসেবে কিছু গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হলোÑআত্মনিয়ন্ত্রণ, একাডেমিক দক্ষতার সঙ্গে ফেসবুক আসক্তির একটা নেতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশোনার সময় এবং শিক্ষণের পরিমাণ দুটোই ফেসবুক আসক্তির কারণে কমে যায়।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ফেসবুকের কারণে আত্মসম্মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা ঈর্ষার জš§ দেয়। যেমন অবকাশ এবং ছুটির দিনের ছবি কথা। অন্যান্য ঈর্ষার কারণগুলোর মধ্যে আছেÑবন্ধু-বান্ধবের পারিবারিক সুখী এবং কারও দৈহিক সৌন্দর্যের ছবি। এ ধরনের ঈর্ষান্বিত অনুভূতি মানুষকে তাদের জীবনে একা এবং অতৃপ্ত করে দেয়। জার্মান দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, তিনজনের মধ্যে একজন ফেসবুক চালানোর পর নিজেদের জীবন নিয়ে অসন্তুষ্ট এবং অন্য একটি গবেষণা যা উটাহ ভ্যালি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত হয়েছিল, উঠে আসে যে, ফেসবুকে সময় কাটানোর পর তাদের জীবন সম্পর্কে  নিকৃষ্ট অনুভূতি হয়েছিল।

২০০৭ সালে প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটেনে ৪৩ শতাংশ কর্মীকে কর্মক্ষেত্রে ফেসবুক ব্যবহার থেকে বিরত রাখা হয়। কারণ দেখানো হয় কর্মীদের উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং ব্যবসায়িক গোপনীয়তা ফাঁস।

গবেষণায় উঠে এসেছে, যেসব মানুষের স্বাস্থ্য ভালো নয়, তারা ফেসবুক ব্যবহার করে দৈনন্দিন জীবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে। আরও দেখা যায়, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের জিপিএ, যারা ফেসবুক ব্যবহার করে না তাদের তুলনায় কম এবং তারা শিখনের ক্ষেত্রে কম সময় ব্যবহার করে। বাংলাদেশের  ৭০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী প্রতিদিন ইন্টারনেট ব্যবহার করে ৪-৬ ঘণ্টা, তাদের মধ্যে ২৭ শতাংশ ফেসবুক ব্যবহার করে ৩ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে। গবেষণা থেকে পাওয়া যায়, ৪৩.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী যারা অতিরিক্ত মাত্রায় ফেসবুক ব্যবহার করে তাদের  ঘুমের সমস্যা দেখা যায় এবং দৈনন্দিন জীবনে মনোযোগ দিতে বিঘœ ঘটায়।

ফেসবুক যেমন বিভিন্ন দিক থেকে আজ আমাদের  সময় নষ্টের কারণ, তেমনি তার বিপরীতে রয়েছে আলোকিত দিক। জীবন এখন অনেক সহজ। মোবাইল ফোনের বদৌলতে হয়তো সবসময় ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না, কিন্তু ফেসবুকের সুবাদে বর্তমান বন্ধুদের থেকে শুরু করে ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে মুহূর্তে যোগাযোগ করা সম্ভব। এ ছাড়াও রয়েছেÑ

ব্যক্তিগত জীবনে নিত্যনতুন মুহূর্ত শেয়ার করা যায়। ব্যবসার উন্নয়নে ফেসবুক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সহপাঠীদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নে সহায়তা করে। অনেক সময় দেখা যায়, ব্যক্তিগত জীবনে অনেকে হতাশ হয়ে ফেসবুকে পোস্ট করে। অনেকে আত্মহত্যার প্রবণতার ইঙ্গিত দিয়ে পোস্ট করে এক্ষেত্রে ফেসবুকের মাধ্যমে তার ফ্রেন্ডলিস্টের বন্ধুরা এসব বিষয়ে অবহিত হয়ে তাকে সমস্যা থেকে বের হতে সহযোগিতা করতে পারে।

যেহেতু মাত্রাতিরিক্ত ফেসবুকের ব্যবহার কোনোভাবেই কাম্য নয়, ফেসবুক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক।

একবিংশ শতাব্দীর এ প্রযুক্তির যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করা প্রয়োজন। কিন্তু এও মনে রাখতে হবে, সারাদিন ফেসবুক-টুইটারে বুঁদ হয়ে মূল্যবান সময়ের অপচয় যেন না করি।

শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০