সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেন সামাজিক অশান্তির কারণ না হয়

আধুনিক জীবনের একপ্রকার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে রয়েছেÑফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইন, পিন্টারেস্ট, টাম্বলার, টুইটার, ভাইবার, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, স্ন্যাপচ্যাট, উইচ্যাট প্রভৃতি। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও অগ্রপথিক হচ্ছে ফেসবুক। সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে এযাবৎকালে আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় আসক্তির নাম ফেসবুক।

আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে তথ্য-প্রযুক্তির চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার ফেসবুক, যা সবার কাছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে পরিচিত। এটি পুরো পৃথিবীটাকে মুহূর্তেই যেন হাতের মুঠোয় এনে দিয়ে এর ভেতর-বাহির চোখের সামনে মেলে ধরে। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন দূরত্বে অবস্থানরত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, শুভাকাক্সক্ষীদের সঙ্গে কুশল বিনিময়, তথ্যের আদান-প্রদানসহ মতামত প্রকাশের সহজ মাধ্যম ফেসবুক অনন্য আবিষ্কার হিসেবে সমাদৃত। সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা দাপ্তরিক যোগাযোগ, বিভিন্ন পণ্যের প্রচারের পাশাপাশি অবসন্ন সময়ে নির্মল বিনোদনের সুযোগও এনে দিয়েছে এ ফেসবুক। এ ছাড়া নিত্যনতুন আবিষ্কারসহ দেশ-বিদেশে সংঘটিত যে কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনা, অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা ও অসংগতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের সহজ মাধ্যম হিসেবেও ফেসবুকের জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। সবকিছু বিবেচনায় ফেসবুক মানুষের কাছে দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানের আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাছে এটি এক ধরনের অভিশাপ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

মিথ্যা প্রচারণা, গুজব ছড়ানো, ধর্মীয়, সামাজিক কিংবা গোষ্ঠীগত উসকানি এবং অশ্লীল ভাষা ও ছবি ব্যবহারের মাধ্যমে পরস্পরের প্রতি অনাস্থা, বীতশ্রদ্ধ ভাব এমনকি সমাজে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির হাতিয়ার হয়ে উঠছে ফেসবুক। কিছু ভুঁইফোড় কথিত অনলাইন মিডিয়া নামধারীও সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে কোনো বিষয় নিয়ে অতিরঞ্জিত প্রচারণা চালায় ফেসবুকে। এমন অনেক বিষয়ও প্রচারণায় আসে, যাতে সাধারণভাবে অনেক নিরীহ সাধারণ ফেসবুক ব্যবহারকারী সরল বিশ্বাসে কথিত বিষয়ের তথ্য, মন্তব্য বা ছবিযুক্ত প্রচারণায় সম্মতিসূচক লাইক, শেয়ার বা পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্য করে থাকেন। পরে যখন জানা যায়, সংশ্লিষ্ট বিষয়টি সঠিক নয়Ñমিথ্যা বা গুজব, তখন এক ধরনের তারা অপরাধবোধে ভোগেন। অতি সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক মনে করছি।

যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ২৫ শতাংশ মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছে, যার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে অন্যের সফলতা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে সৃষ্ট হতাশা। ফেসবুকে আপলোড করা বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী কিংবা আত্মীয়ের রঙিন জীবনের ছবি অন্যকে ঈর্ষাকাতর করে তোলে। সেই ঈর্ষাকাতরতা থেকে জš§ নেয় জীবনের প্রতি হতাশা।

শুধু তাই নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিজের দেহাবয়ব থেকে শুরু করে ব্যক্তির আদর্শ ও বিশ্বাসের ভিত পর্যন্ত নাড়িয়ে দিতে সক্ষম। তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে এবং কম বয়স্ক মানুষের ওপরই ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের প্রভাব সবচেয়ে বেশি।

আমেরিকা প্রবাসী ডাক্তার ফেরদৌস খন্দকার বঙ্গবন্ধুর খুনি চক্রের অন্যতম খন্দকার মোশতাক আহমদের ভাগনে এবং আরেক খুনি শাহরিয়ার রশিদের আত্মীয় উল্লেখ করে এক প্রবাসী বাঙালির স্ট্যাটাসকে বিশ্বাস করে বড়-ছোট অনেকে সেটি শেয়ার করেন এবং ডাক্তার ফেরদৌসকে নিয়ে নানারকম মন্তব্য করেন। স্বাভাবিকভাবে খুনি চক্রের হোতা মোশতাকের ওপর ঘৃণার আগুনের ঢেউ আছড়ে পড়ে ডা. ফেরদৌসের ওপর। তার রাজনৈতিক পরিচয় নিয়েও নানা প্রশ্ন তোলা হয়। পরে দেখা যায় ডা. ফেরদৌসের বাবার নামও খন্দকার মোশতাক, যিনি এখনও বেঁচে আছেন। খুনি মোশতাক বা রশিদ তার আত্মীয় নন। পরে ডা. ফেরদৌসসহ নানা মহল থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হতে থাকলে সরল বিশ্বাসে মন্তব্যকারীরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন।

দেখা যায়, বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস কিংবা রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী ব্যক্তিদের নিয়ে বিভিন্ন জন ভালোমন্দ স্টাটাস দিয়ে থাকেন। এসবের পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্য করেন নানাজন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু অনেক সময় কারও বক্তব্য পছন্দ না হলে প্রতিপক্ষ জবাবে এমন এমন মন্তব্য করেন, যা এককথায় অশ্রাব্য ও অশ্লীল। নানা রকম হুমকি-ধমকিও দেয়া হয় ফেসবুকে। এ ছাড়া ফেসবুকে আসক্তির বিষয়টিও উদ্বেগজনক। স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অনেকে রাত-দিনের বড় একটা সময় ফেসবুকে বুদ হয়ে থেকে পড়ালেখাসহ নিজ নিজ দায়িত্ব পালন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এতে ক্রমান্বয়ে পারিবারিক অশান্তিও বাড়ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

যে কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ভালোমন্দ দুটো দিক থাকে। এসব আবিষ্কারের সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত ব্যবহারে সমাজের কল্যাণ যেমন হয়, তেমনই অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ডেকে আনে অশান্তি। কাজেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেন সামাজিক অশান্তির কারণ না হয়, সেদিকে সবার দৃষ্টি দেয়া কর্তব্য।

মো. জাহিদ হোসাইন

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০