Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 11:37 am

সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো আধিপত্য বিস্তারে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে

আবুল কাসেম হায়দার: চীন বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম রাষ্ট্র। শুধু জনসংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তম নয়, উন্নতি ও অগ্রগতিতেও চীন বর্তমান বিশ্বে অনেক বেশি শক্তিশালী দেশ। চীনকে বলা হয় ‘পিপলস রিপাবলিক অব চায়না’ (গণপ্রজাতন্ত্রী চীন)। সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিক থেকে চীন অনেক বেশি প্রাচীন। ইরান, ভারত, ইরাক ও মিয়ানমারের মতো প্রাচীন চীনের সভ্যতা। ১৯৪৯ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবের পর এক নতুন চীনের যাত্রা শুরু হয়। নানারকম সংস্কার ও পরিবর্তনের পর বর্তমান বিশ্বে চীন অন্যতম এক পরাশক্তি। জিডিপির হিসাবে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফসল নয়া চীন এখন পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্র।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে জ্বালানি সম্পদে সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্র রাষ্ট্রের যেসব বৃহৎ কোম্পানির দীর্ঘকাল আধিপত্য ছিল, সেগুলো একনামে সাতভগ্নি নামে পরিচিতি পেয়েছিল।  সব কোম্পানি ছিল পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানি। তাদের সেভেন সিস্টার বা সাতভগ্নি নামকরণ করেন ইতালির রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানির কর্মকর্তা এনরিকো মেত্তাই। এই সাত কোম্পানি পরে নানাভাবে পরিচিতি লাভ করে। শুরুতে এগুলোর নাম ছিলÑ(১) অ্যাংলো পারসিয়ান অয়েল কোম্পানি, বর্তমানে বিপি; (২) গালফ অয়েল, পরে সাকিন কোম্পানি শেভরন, অঙ্গীভূত; (৩) স্ট্যান্ডার্ড অয়েল অব ক্যালিফোর্নিয়া, এখন শেভরন; (৪) টেক্সাকো, পরে শেভরনের অঙ্গীভূত হয়; (৫) রয়েল ডাচ শেল; (৬) স্ট্যান্ডার্ড অয়েল অব নিউজার্সি, পরে এক্সন এবং (৯৭) স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি অব নিউইয়র্ক, পরে মবিল, তারও পরে এক্সনমবিলের অংশ।

১৯৭৩ সালের তেল সংকটের আগ পর্যন্ত এই কোম্পানিগুলোই বিশ্বের জ্বালানি তেল-গ্যাস মজুতের শতকরা ৮৫ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করত। গত দুই দশকে পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য পত্রিকা ফাইন্যান্সিয়াল বলছে, পুরোনো সাতভগ্নি থেকে বিকশিত যুক্তরাষ্ট্রের এক্সনমবিল ও শেভরন, ইউরোপের ব্রিটিশ পেট্রেলিয়াম (বিপি) এবং রয়েল ডাচ সেল এখন অস্তিত্বের সংকটে। ওই সিঁড়ির বাইরে তখন বিকশিত হয়েছে নতুন সাতভগ্নি।

বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস এ নতুন সাতভগ্নির তালিকা তৈরি করেছে। এ নতুন সাতটি ক্ষমতাধর জ্বালানি শক্তি হচ্ছেÑ১. সৌদি আরামকো, ২. রাশিয়ার গ্যাজপ্রম, ৩. চাইনিজ ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশান (সিএনপিসি), ৪. ন্যাশনাল ইরানিয়ান অয়েল করপোরেশন (এনআইওসি), ৫. ভেনিজুয়েলার পিডিভিভএসও (পিডিভিএসএ), ৬. ব্রাজিলের পেট্রোব্রাস ও  ৭. মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস। আগের তুলনায় পার্থক্য হচ্ছে উল্লিখিত সব প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয়। বর্তমান বিশ্বে এক-তৃতীয়াংশ তেল ও গ্যাস মজুত ও উৎপাদন এ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে। পুরানো সাতভগ্নি যা পরে চারটি সংস্থায় অগ্নীভূত হয়েছে, তাদের হাতে তখন তিন শতাংশ মজুত আছে। তারা উৎপাদন করে শতকরা ১০ ভাগ। সূত্র: ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস, ১২ মার্চ ২০০০।

গত দুই দশকে বিশ্বে জ্বালানি খাতে চীনের অংশগ্রহণ ও কর্তৃত্ব খুবই দ্রুতগতিতে বেড়েছে। একদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চীনের রাষ্ট্রীয় কোম্পানির বিনিয়োগ, খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্বালানি আমদানিতে চীনা প্রতিষ্ঠানের তৎপরতা বেড়েছে। অন্যদিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তি রপ্তানি প্রভৃতি ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা এখন বিশ্বের প্রথম সারিতে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের তেল-গ্যাস কোম্পানি ও রাষ্ট্রীয় ব্যাংকসহ অর্থসংস্থানকারী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও বেশ মুখ্য।

সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো বিশ্ববাজার দখল এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সব সময় সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করেছে। একই সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক চাপ ও প্রভাববলয় সৃষ্টির তৎপরতা চলছে ব্যাপকভাবে। তবে দুই ক্ষেত্রেই অধিপতি রাষ্ট্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এসব রাষ্ট্র সামরিক শক্তি নির্মাণ করে, বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করে এবং বহুজাতিক কোম্পানির অধিপত্য বিস্তার ঘটিয়ে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার সম্প্রসারণ করেছে। চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে সামরিক শক্তি বা এসব প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার কোনো ভূমিকা কখনও ছিল না। চীন তার রাষ্ট্রীয় অর্থসংস্থানকারী প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় অবস্থান নিশ্চিত করে বাণিজ্যিক আধিপত্য সম্প্রসারণ করছে। বিশেষত, ২০০৮ সালের বিশ্ব আর্থিক সংকটের পর চীন পরিকল্পিতভাবে নিজস্ব রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী ব্যাংকগুলোকে সক্রিয় করেছে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জ্বালানি খাতকে বিনিয়োগে অগ্রাধিকার দিয়েছে, ত্বরিত অর্থসংস্থান নিশ্চিত করেছে, সর্বোপরি এসব বিনিয়োগ দ্রুত করতে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে আসছে।

বিশ্বজুড়ে জ্বালানি খাতে চীনা সংস্থাগুলোর কর্তৃত্ব সম্প্রসারণের পেছনে চীনা রাষ্ট্রের এবং তাদের সমর্থিত ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসা প্রসারের আগ্রহ যেমন কাজ করেছে, তার চেয়ে বেশি কাজ করেছে বিদেশি জ্বালানির ওপর কর্তৃত্ব নিশ্চিত করে চীনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর তাগিদ। সঙ্গে সঙ্গে চীনের রপ্তানিযোগ্য জ্বালানি সামগ্রিক বাজার সম্প্রসারণ ও অন্যতম লক্ষ্য ছিল। চীনের বিশাল বৈদেশিক মুদ্রার মজুত চীনকে এসব প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে সমর্থ করে তুলেছে। এর মধ্যে চীন তিনটি লক্ষ্য পূরণে সক্ষম হয়েছে ১. কৌশলগত সম্প্রসারণ; ২. জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ; এবং ৩. চীনা মুদ্রা রেনমিনবির আন্তর্জাতিকীকরণ। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ এই বিশাল যোগাযোগ কর্মযজ্ঞ এ যাত্রাকে অধিকতর গতিশীল করবে, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক’ এবং ব্রিকসের ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ প্রকল্প চীনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শক্তিশালী সমর্থন হিসেবে কাজ করবে।  

২০০০ সাল থেকে চীন জ্বালানি সামগ্রী রপ্তানিতে যেহারে সমৃদ্ধি অর্জন করছে, তা বিশ্বে আগের চেয়ে বেশি। এ সময়ে চীন জ্বালানিসামগ্রী রপ্তানি করছে ৫০০ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে যে পরিমাণ রপ্তানি করে, চীন এখন তার অর্ধেকের বেশি করছে। জলবিদ্যুৎ ও সোলার প্যানেল রপ্তানিতে চীন এরই মধ্যে বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করেছে। চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় এসব প্রযুক্তি চার-পাঁচগুণ বেশি রপ্তানি করে। এছাড়া চীন বিদ্যুৎ প্লান্ট রপ্তানিতেও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিগুণ অবস্থান দখল করেছে। এক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ যখন ৯ শতাংশ, তখন চীনের অংশীদারিত্ব ১৮ শতাংশ। তবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারে চীনের অগ্রযাত্রা যে মসৃণ হবে না, তার পরিষ্কার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে চীনবিরোধী বিভিন্ন সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট গঠনের মধ্যে।

প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান

ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, আইএফআইএল

আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম

aqhaider@youthgroupbd.com