শেয়ার বিজ ডেস্ক: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণার পর গতকাল সোমবার ঢাকাসহ সারাদেশে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন, গুম ও খুনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। এ সময় বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিতে পুলিশ লাঠিপেটার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় টিয়ারশেলও নিক্ষেপ করে। একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি স্থান থেকে বিক্ষোভকারীদের আটক করেছে।
গতকাল দুপরে রাজধানীর মিরপুর ১০, ইসিবি চত্বর ও ধানমন্ডির স্টার কাবাব এবং সাইন্সল্যাব বিক্ষোভ মিছিলের জন্য জড়ো হওয়া আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করেছে পুলশি। সেখান থেকে ২০ বিক্ষোভকারীকে আটক করেছে পুলিশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গতকাল ঢাকার আটটি স্থানে বিক্ষোভ কর্মসূচি হবে বলে জানানো হয়েছিল। এই আট স্থান হচ্ছেÑসায়েন্স ল্যাব, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ নম্বর গেট, প্রেস ক্লাব, উত্তরার বিএনএস সেন্টার, মিরপুর-১০, মিরপুরের ইসিবি চত্বর, রামপুরা ও মহাখালী।
সকাল থেকেই এসব এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করতে দেখা গেছে। পাশাপাশি র?্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র?্যাব) হেলিকপ্টারের টহলও দেখা গেছে। সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে টহল দিতে দেখা গেছে।
বিক্ষোভ কর্মসূচির সময় মিরপুর ১০ নম্বরের গোলচত্বর থেকে ১০ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মিরপুর থানার ওসি মুন্সি ছাব্বীর আহম্মেদ। ধানমন্ডির স্টার কাবাবের সামনে থেকে ১০ জনকে আটকের কথা জানিয়েছেন নিউমার্কেট জোনের সহকারী কমিশনার মো. রেফাতুল ইসলাম।
দুপুর সাড়ে ১২টায় ইসিবি চত্বরে দায়িত্বরত পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, কয়েকজন বিক্ষোভকারী গলি থেকে ইটপাটকেল ছুড়ছিল। পরে পুলিশ তাদের সরিয়ে দিয়েছে ও কয়েকজনকে আটক করেছে।
উত্তরার বিভিন্ন মোড়ে পুলিশ অবস্থান নেয়। বিভিন্ন রাস্তা ও গলিতে কিছু মানুষকে দেখা যায়। তবে মূল সড়কে কাউকে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে নামতে দেখা যায়নি। পূর্বঘোষিত আন্দোলনের অংশ হিসেবে গতকাল দুপুরে ঢাকার পুরানা পল্টনে জড়ো হওয়া বেশ কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ।
চট্টগ্রাম নগরের চেরাগী মোড়ে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। গতকাল বিকাল ৪টায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশ কয়েকজনকে আটক করে।
গতকাল ৩টায় নগরের জামালখানে প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি করার কথা বলেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তবে এর আগেই ওই এলাকায় পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেন। ফলে সেখানে কোনো শিক্ষার্থী জড়ো হননি।
তবে বেলা সাড়ে ৩টায় চেরাগী পাহাড় মোড়ে অবস্থান নেন ২০ থেকে ৩০ বিক্ষোভকারী। সেখানে তারা সেøাগান দিতে থাকেন। এ সময় পুলিশ দুজনকে আটক করে প্রিজন ভ্যানে তুলতে চাইলে বিক্ষোভকারীরা বাধা দেন। তারা প্রিজন ভ্যানের সামনে সড়কের ওপর বসে পড়েন। তবে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাদের নিয়ে যায়। এ সময় আওয়ামী লীগের এক সমর্থকও বিক্ষোভকারীদের মারধর করেন।
এরপর বিক্ষোভকারীরা মোড়ের এক পাশে সড়কে বসে সেøাগান দিতে থাকেন। এভাবে ১৫ মিনিট বসে থাকার পর পুলিশ দুটি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। প্রত্যক্ষদর্শী ও বিক্ষোভকারী সঙ্গে কথা বলে এবং সরেজমিনে দেখা যায়, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপের পর বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এরপর পুলিশ লাঠিপেটা করে সবাইকে সরিয়ে দেয়। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে অন্তত ১৫ সাধারণ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। গতকাল বেলা ২টায় এই হামলার ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ব্যানারে রাজনীতি করেন এমন শিক্ষার্থীরা লাঠি, রড, পাইপ নিয়ে এই হামলা চালান। আহতদের মধ্যে ৯ জনকে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন, গুম ও খুনের প্রতিবাদে সরকারি বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা গতকাল দুপুরে বিক্ষোভ করেন। ক্যাম্পাস থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে তারা নগরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল নথুল্লাবাদ এলাকায় যান। পরে বিক্ষোভকারীদের সেখানে আটকে দেয় পুলিশ। তখন তারা সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শিক্ষার্থীরা ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। গতকাল দুপুর পৌনে ১২টায় তারা এ কর্মসূচি শুরু করেন। এর আগে বেলা সাড়ে ১১টায় শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে জড়ো হতে থাকেন। এরপর ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীসংখ্যা বাড়লে সেøাগান শুরু হয়। এ সময় পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষার্থীরা অবস্থান কর্মসূচিতে ও বিক্ষোভ মিছিলে নানা ধরনের সেøাগান দেন। এর মধ্যে রয়েছেÑ‘আমার ভাই মরল কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত’, ‘মানতে হবে মানতে হবে, ৯ দফা মানতে হবে’ এবং ‘শহিদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারাদেশে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিচার দাবিতে নোয়াখালী-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়ক অবরোধ করেছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকাল ৩টায় নোয়াখালী জিলা স্কুলের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে সোনাপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ, নোয়াখালী জেলা স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেন। বিক্ষোভকারীরা জানান, দেশব্যাপী ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলায় শিক্ষার্থী নিহতের বিচার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দেয়া ৯ দফা দাবিতে তারা বিক্ষোভ করছেন। শিক্ষার্থীদের নিহত হওয়ার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, বিচারসহ ৯ দফা দাবিতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) প্রধান ফটকের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গতকাল বিকাল ৩টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে শতাধিক শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন শুরু করেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিক্ষোভের সময় শিক্ষার্থীরা ‘স্বৈরাচারের গদিতে আগুন জ্বালো একসাথে’, ‘গুলি করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না’সহ নানা সেøাগান দিতে থাকেন। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক বন্ধ করে ভেতরে অবস্থান নেয় পুলিশ ও বিজিবি। এছাড়া নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানে ছিল সেনাবাহিনীও।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মুক্তি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক হয়রানি বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বেলা আড়াইটায় রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সামনে তারা এই সমাবেশ করেন।
তারা জানান, প্রেস ক্লাবের সামনে তাদের এই কর্মসূচি পালনের কথা থাকলেও পুলিশ বাধা দেয়ায় তারা ডিআরইউর সামনে গিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন।
সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বলেন, চলমান কোটা আন্দোলন দমাতে শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন চেক করছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই অধিকার তাদের কে দিয়েছে? রাতের বেলা তারা প্রত্যেক মেসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করছে। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের অবিলম্বে মুক্তির দাবি তোলেন সমাবেশকারীরা। সেই সময় ৯ দফা দাবি আদায় না হলে রাজপথে থাকার ঘোষণা দেন তারা।