সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করা জরুরি

রিপন চন্দ্র পাল : দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী সহযোগিতা সংস্থা হলো সার্ক। ১৯৮৫ সালের গঠিত হওয়া এই সংস্থা এখন মৃতপ্রায়। নামেমাত্র জীবিত কিন্তু কাজে নেই। সর্বশেষ নেপালে ২০১৪ সালে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পরে ২০১৯ সালে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই বৈঠকের আগেই ভারতীয় নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরি সেক্টরে এক সন্ত্রাসী হামলার জেরে ভারত উক্ত বৈঠকে অংশ নিতে আপত্তি জানায় এবং পরপরই বাংলাদেশসহ আরও সদস্য দেশের মতানৈক্যের কারণে আর কোনো শীর্ষ সম্মেলন হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান আবার সার্কের শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগী হয়। তবে ভারত আগের অবস্থা বহাল থাকার কথা বলে আবারও সম্মেলন বাতিল করে।

পরপর এসব শীর্ষ সম্মেলন বাতিলের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত যেই প্রকারের বড় ভাই গোছের রাষ্ট্র ছিল ক্রমে তা থেকে ছিটকে পড়ছে। সাম্প্রতিক কভিডের সময়েই যে পরিমাণ ভ্যাকসিন সরবরাহ করার কথা ছিল সেসব তারা করতে পারেনি। আবার ক্রমশ ভারতের অন্যতম মিত্র এবং পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে যেটুকু সম্পর্ক বজায় রাখার কথা ছিল সেসবও এখন নড়বড়ে। কারণ প্রতিনিয়ত সীমান্ত হত্যা, ন্যায্য পানির হিস্যা এবং বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গাদের বাড়ি ফেরাতে ভারতের যেটুকু উদ্যোগ নেয়ার কথা আশা করেছিল সেটুকু না পাওয়ায় বাংলাদেশ এখন অভিমান করে বসে আছে। অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশেই যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অস্থিতিশীলতা চলছে তা নিয়ে দু’পাড়ের জনতাই একে অপরের প্রতি ক্ষোভ বজায় রাখছে। ফলে ক্রমাগতই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে।

দাঁড়িপাল্লায় যখন অসম অবস্থার উদ্ভব হয় তখন একটা দিক একদম উঁচু আর অন্যদিক নিচু হয়ে যায়। দক্ষিণ এশিয়ায়ও বর্তমানে এ অবস্থাই চলছে। ভারতের এ অঞ্চলে যে স্বীয় অনুপস্থিতি তৈরি করছে, তা যেন পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের মাধ্যমে চীনকেই ডাকা হচ্ছে। বিগত বছরগুলোতে আমরা দেখতে পেয়েছি যে, পাকিস্তান নানাভাবে বাংলাদেশকে বার্তা পাঠাচ্ছে। যেমন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বাংলাদেশের বিজয় দিবসে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ভিডিও বার্তা পাঠাচ্ছে কিংবা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করছেন, চিঠি চালাচালি পর্যন্ত হয়েছে। আবার বাংলাদেশও ইমরান খানের উদ্দেশে আমসহ নানা কিছু উপহারসামগ্রী হিসেবে পাঠাচ্ছে। এতে অন্তত এটাই বুঝা যায়, দু’দেশই নিজেদের কাছে আসতে চাইছে। কিন্তু বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে সংলাপে যাক বা একাত্ম হয়ে এ অঞ্চলে কাজ করুক, সেটা ভারত চায় না। সেটা করলে ভারতের অবস্থাই সংকটাপন্ন হতে পারে। আবার পাকিস্তান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ওপরে যে বর্বর-অরাজকতা চালিয়ে ছিল, সেটার ক্ষোভ এখনও বাংলাদেশ বহন করে যাচ্ছে।

আঞ্চলিক সংস্থা সার্ক গঠন হওয়ার পেছনে  অনেকগুলো উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু পরপর শীর্ষ সম্মেলন বাতিল হওয়ার মাধ্যমে আঞ্চলিক যোগাযোগ, বাণিজ্য এবং কূটনৈতিক বিষয়ে আলাপ-আলোচনাও হ্রাস পায় এবং এতোদঞ্চলের রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে নানা ইস্যুতে সার্কের অনিষ্ক্রিয়তা বা অনুপস্থিতিতে যে শূন্য স্থানের তৈরি হয়েছে সেটা এ অঞ্চলের জন্য অশনিসংকেত। ভারত সার্ক নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো তেমন কিছুই করছে না অথচ একই রকমের বিকল্প চিন্তা-ভাবনা করেছে। উল্টো দিকে পাকিস্তানও সার্ক নিয়ে ততোটা সচেতন অবস্থায় নেই। যদি হতো তাহলে পাক-ভারতের মধ্যে অন্তত পাকিস্তান তাদের কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে শীর্ষ সম্মেলনের ব্যবস্থা করত। কিন্তু বর্তমানে পাকিস্তানেরও লক্ষ্য চীনভিত্তিক সার্কের বিকল্প সংস্থা গঠন করা। অর্থাৎ পাকিস্তান-ভারত পরস্পর পরস্পরকে কোণঠাসা করার যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে এই অঞ্চলে আঞ্চলিক আলোচনা-সংলাপের জায়গায় একটা বড় ফাঁকা স্থানের উদ্ভব হয়েছে।

চীন উদ্ভুত ফাঁকা স্থানের সদ্ব্যবহার করতে চায়। এ জন্যই ২০১৮ সালে প্রথম ‘চীন দক্ষিণ এশিয়া সহযোগিতা ফোরাম’ (সিএসএসিএফ)-এর সূচনা করে। যেখানে বাংলাদেশসহ পাঁচটা দেশ এর প্রশংসা করে। বলা চলে যে, এই অঞ্চলে আঞ্চলিক সংলাপে প্রবেশে চীনের অন্যতম একটা পদক্ষেপ। সঙ্গে তো চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্প আছেই। এসবের মাধ্যমে ক্রমাগত চীন এসব অঞ্চলের দেশকে অবকাঠামোগতভাবে এবং আর্থিক ও সহযোগিতার কথা বলে ঘিরে ফেলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আপাততভাবে পাকিস্তান চীনের নিকটতম মিত্র। এভাবে ভারত একদিকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। আবার সর্বশেষ ২০২০ সালের মে মাসে লাদাখে ভারত-চীন সংঘাতে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক অকেজো হয়ে পড়ে। এখন চীনের লক্ষ্য শ্রীলঙ্কা। যেটা ইতোমধ্যে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। চীন যদি ক্রমশ শ্রীলঙ্কায় প্রভাব বৃদ্ধি করে তাহলে ভারতের কোণঠাসার পালে নব হাওয়া লাগবে। এদিকে পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে দূরত্ব কাটানোর চেষ্টা তো চালাচ্ছেই। জার্মানি যেভাবে নামিবিয়ার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা চেয়েছে একইভাবে চীনের তৎপরতায় পাকিস্তানও যদি বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চেয়ে ফেলে তা হলে বলা যায় যে, ভারত ষোলোআনাই কোণঠাসা হয়ে পড়বে। যেটা পাকিস্তান-চীনের লক্ষ্য ছিল।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের পর বাইডেন প্রশাসন গদিতে এসে দক্ষিণ এশিয়ার উদ্ভূত অবস্থা ঠাহর করতে পেরে এ অঞ্চল নিয়ে তাদের যে নীতি ছিল, সেটাতে বিশেষভাবে লক্ষ্য দিচ্ছে। তারই জলন্ত প্রমাণ হলো ‘কোয়াড’। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ এবং চীনের প্রভাব রোধ করতে চায়। উপরোল্লিখিত যে কভিড ভ্যাকসিন রাজনীতিতে ভারত যেই অপরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছে তাই যুক্তরাষ্ট্র এখন আর ভারতের চোখ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়াকে দেখতে চায় না। নানা রকম প্রভাব-প্রতিপত্তি দিয়ে এসব অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোকে হাতে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার দৃষ্টান্ত হলো বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনি ‘র‌্যাব’কে নিষেধাজ্ঞা প্রদানের মাধ্যমে নিজের প্রভাব পুনঃবহাল রাখা। তাই বলা যায় যে, আঞ্চলিক সংস্থা সার্কের ভগ্ন দশার মধ্য দিয়েই চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই নিবিড়ভাবে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। আবার বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগে এবং অস্ত্র ক্রয়ের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়েছে। সেই ঝুঁকে পড়ার পালে হাওয়া লাগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা। ফলে বাংলাদেশ এখন যদি অতিরিক্ত চাপে একদম চীনামুখো হয়ে যায়, তাহলে সেটা ভারতের জন্য যেমন ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াবে, তেমনি দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো আঞ্চলিক বিশৃঙ্খলার সমূহ সম্ভাবনার দ্বারে কড়া নাড়বে। মোদ্দা কথা হলো, বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় উšে§াচিত হতে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি হচ্ছে, নিরপেক্ষ থাকা বা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখা। ভ্যাকসিন ক্রয় এবং অস্ত্র ক্রয়ে বাংলাদেশ যেভাবে চীনমুখী হয়েছে, ভবিষ্যতের সম্ভাব্য কূটনৈতিক সংকটে স্বীয় স্বার্থ রক্ষা করে কীভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। 

শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০