Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 9:56 pm

সার্বিক বিবেচনায় করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো প্রয়োজন

মো. জিল্লুর রহমান: আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট এবং ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য্য করে গত ৯ জুন জাতীয় সংসদে জাতীয় বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরেও ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকায় স্থির রয়েছে। বিগত দুই বছর করদাতারা প্রতি বছরই ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধির প্রত্যাশা করেছেন কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ২০২০-২০২১ অর্থবছরে করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ টাকায় বৃদ্ধি করা হয়েছিল।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের মতো আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তিগত আয়সীমা ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত রাখা হয়েছে। এছাড়া প্রস্তাাবিত বাজেট অনুযায়ী যাদের আয় ৩ লাখ টাকার চেয়ে বেশি তাদের পরবর্তী এক লাখ টাকার জন্য ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৩ লাখ টাকার জন্য ১০ শতাংশ, পরবর্তী চার লাখ টাকার জন্য ১৫ শতাংশ, পরবর্তী পাঁচ লাখ টাকার জন্য ২০ শতাংশ এবং এর বেশি পরিমাণ আয়ের জন্য ২৫ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে। এছাড়া, নারী ও ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের করদাতাদের জন্য ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার,  প্রতিবন্ধী করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা রাখা হয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে করদাতাদের মোট আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ বিনিয়োগ করার সুযোগ ছিল কিন্তু আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সেটি ২০ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকারান্তরে এর ফলে ব্যক্তিশ্রেণির আয়কর বাড়বে এবং এটা করদাতাদের সঙ্গে এক ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি। 

করমুক্ত আয়সীমা তো একদিকে বাড়েনি; বরং অন্যদিকে সরকারের কিছু সেবা পেতে হলে বার্ষিক আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে। যেমন কেউ যদি ব্যাংকের সুদ আয় তুলতে যান, তাহলে উৎসে কর কেটে রাখে। এত দিন করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) সনদ দেখালেই সুদ আয়ের ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর কাটত। এখন থেকে এই সুবিধা পেতে হলে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র ব্যাংকে দেখাতে হবে। টিআইএন সনদের পরিবর্তে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দাখিলে ব্যর্থ হলে ঠিকাদার বা সরবরাহকারীর কাছ থেকে বাজেটে ৫০ শতাংশ বেশি হারে উৎসে কর কেটে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। মূলত নতুন বাজেটে ৩৮ ধরনের সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে বিষয়টি একটু ঘুরিয়ে করা হয়েছে। যে দপ্তর বা প্রতিষ্ঠান থেকে এসব সেবা নেয়া হবে, সেসব প্রতিষ্ঠান যদি সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দেখতে না চেয়ে সেবা দিয়ে দেয়, তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার বিধান রাখা হয়েছে। যেসব সেবা পেতে রিটার্ন জমা দিতে হবে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পাঁচ লাখ টাকার বেশি ঋণের জন্য আবেদন, পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র ক্রয়, ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ, কোনো কোম্পানির পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার হওয়া, ব্যবসায়িক সমিতির সদস্যপদ গ্রহণ, সন্তান বা পোষ্যের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ালেখা করা ও অস্ত্রের লাইসেন্স নেয়া। এছাড়া উপজেলা, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হলে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে। এত দিন শুধু এসব খাতের সেবা নিতে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু এবার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে রিটার্ন দাখিলপত্র দেখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যেখানে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা এবং রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। পক্ষান্তরে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা এবং রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা এবং রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা, পক্ষান্তরে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা এবং রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বিগত সাত বছরে বাজেটের আকার ও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দ্বিগুণের বেশি হয়েছে অথচ করমুক্ত আয়সীমা দুই বছর আগে আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিয়মানুযায়ী আয়কর হচ্ছে ব্যক্তি বা সত্তার আয় বা লভ্যাংশের ওপর প্রদেয় কর। আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর আওতায় কর বলতে অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রদেয় আয়কর, অতিরিক্ত কর, বাড়তি লাভের কর, এতদসংক্রান্ত জরিমানা, সুদ বা আদায় যোগ্য অর্থকে বোঝায়। অন্য ভাবে বলা যায়, কর হচ্ছে রাষ্ট্রের জনগণের স্বার্থে রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারকে প্রদত্ত বাধ্যতামূলক অর্থ।

আয়কর যা আয় বা লভ্যাংশের পরিমাণ ভেদে পরিবর্তিত হয় এবং আমাদের দেশে প্রগতিশীল কর প্রয়োগ করা হয়। প্রগতিশীল কর হচ্ছে সেই কর ব্যবস্থা যাতে করদাতার আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে করহার বৃদ্ধি হয়। আয়কর আরোপিত হয় করদাতার কর পরিশোধ করার ক্ষমতার ওপর। তাই আয়কর প্রগতিশীল কর বলা হয়। আয়কর অধ্যাদশে ১৯৮৪ অনুযায়ী আয়ের খাতগুলো হচ্ছে বেতনাদি, নিরাপত্তা জামানতের ওপর সুদ, গৃহ সম্পত্তির আয়, কৃষি আয়, ব্যবসা বা পেশার আয়, মূলধনি মুনাফা, অন্যান্য উৎস হতে আয়, ফার্মের আয়ের অংশ, স্বামী/স্ত্রী বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের আয়। তবে রিটার্ন জমা দেয়ার সময় আয়ের খাতগুলো সম্পৃক্ত করতে হয়।

আবার গত সাত বছরে মুদ্রাস্ফীতি গড়ে পাঁচ শতাংশের বেশি বেড়েছে, নিত্যপণ্যের মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে দুই তিন গুণ, মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতাও বেশ হ্রাস পেয়েছে অথচ ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকায়ই স্থির রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মুদ্রাস্ফীতিকে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে গণ্য করেন। কারণ মুদ্রাস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, মধ্য ও নিন্মবিত্ত আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়িয়ে দেয় এবং ভোক্তাদের জীবনমানকে দুর্বিষহ করে তোলে। মানুষ একসময় হতাশায় নিমজ্জিত হয় এবং সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যায়। ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতির চাপ এবং প্রকৃত মজুরি কমে যাওয়ায় নি¤œ মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোগযোগ্য আয়ের ওপর বেশ চাপ তৈরি করছে এবং জীবন-জীবিকা চালানো বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া, বিগত দুই বছর কভিড-১৯ এর প্রভাবে মানুষের জীবন-জীবিকা চরম সংকটময় মুহূর্ত অতিক্রম করেছে এবং এর প্রভাবে মানুষের আয়কর প্রদান খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবন এমনিতেই ওষ্ঠাগত। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পরিবহন ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দফায় দফায় মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়েছে। বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, রান্নার গ্যাস, পেঁয়াজ, শাকসবজি থেকে শুরু করে এমন কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নেই, যার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে না। অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়েছে, মাথাপিছু আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণহীন ঊর্ধ্বগতি ভোক্তাকে খুশি করতে পারছে না। বাজারে অগ্নিমূল্যে ভোক্তারা নির্বিকার, বিশেষভাবে নি¤œআয়ের মানুষ যা আয় করছে, তার পুরোটাই জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যদ্রব্য কিনতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রভৃতির জন্য ব্যয় করার মতো অর্থ তাদের হাতে আর থাকছে না। সরকারের টিসিবির গাড়ির সামনে ভোক্তাদের দীর্ঘ লাইনই বলে দেয় তারা দ্রব্যমূল্যের কাছে কতটা অসহায়!

বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি পেরিয়ে গেছে এবং এর মধ্যে ৭৫ লাখের অধিক নাগরিকের করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) আছে। কিন্তু বছর শেষে আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন জমা দেন মাত্র ২৫ লাখ। তাদের মধ্যে ৭-৮ লাখ সরকারি কর্মকর্তা। প্রতি মাসে বেতন-ভাতা প্রদানের সময় ‘পে রোল ট্যাক্স’ হিসেবে কেটে রাখা হয়। অন্যদিকে যারা বছর শেষে রিটার্ন জমা দেন, তাদের কমবেশি ১০ শতাংশ শূন্য রিটার্ন জমা দেন। এর মানে, তারা কোনো কর দেন না। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে তাদের কোনো ভ‚মিকা থাকে না। যাদের টিআইএন আছে তাদের অধিকাংশই মোটেই আয়কর দেন না, তাদের কাছ থেকে সঠিকভাবে কর আদায় না করে স্বেচ্ছায় কর প্রদানকারীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায় করা হচ্ছে। এটা একদিকে যেমন চরম পক্ষপাতদুষ্ট, অন্যদিকে সুষম কর নীতির পরিপন্থিও বটে। এটা প্রকারান্তরে যারা নিয়মিত আয়কর পরিশোধ করছে তাদের নিরুৎসাহিত করছে।

২০২০-২১ সালে বাজেট ঘোষণার সময়ে করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা করা হয়। এর আগে ২০১৫-১৬ সালে বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা ২ লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে আড়াই লাখ টাকা করা হয়েছিল। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির জেরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়ায় এবং কভিড সংকটে সাধারণ মানুষের আয় কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদসহ সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ নতুন বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন।

গত তিন মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের ওপরে রয়েছে। এর মানে, সংসারের খরচ আগের চেয়ে বেড়েছে। ব্যক্তিশ্রেণির যেসব করদাতার বার্ষিক আয় তিন লাখ টাকার কিছু বেশি, তাদের খরচ বেড়েছে। কিন্তু আগামী বছর তাদের আগের মতোই কর দিতে হবে, যা অনেকের জন্যই বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। তবে করমুক্ত আয়ের সীমা না বাড়ালে প্রতি বছরই কিছু লোক করজালে অন্তর্ভুক্ত হন। অন্যদিকে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হলে কিছু করদাতা করজাল থেকে বেরিয়ে যান। উপরোক্ত বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে, সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা থেকে বাড়েয়ে পাঁচ লাখ টাকায় নির্ধারণ করে বাজেট পাস করা হোক।

ব্যাংক কর্মকর্তা ও  মুক্ত লেখক

Rbbbp@gmail.com