Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 4:12 pm

সার আমদানির অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না সরকার

রোহান রাজিব: বেসরকারি খাতের আমদানিকারকরা ২০২২-২৩ অর্থবছরে সার আমদানির ভর্তুকি বাবদ সরকারের কাছে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি পায়। বিপুল অঙ্কের এই অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না সরকার, যার কারণে সার আমদানিকারকরা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে অতি জরুরি উল্লেখ করে সম্প্রতি বেসরকারি পর্যায়ের সার আমদানিকারদের ঋণখেলাপি না করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এ সংক্রান্ত একটি চিঠি শেয়ার বিজের হাতে এসেছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, গত ২০০৪-০৫ অর্থবছর থেকে বেসরকারি খাতে আমদানিকৃত সারে ভর্তুকি কার্যক্রম শুরু হয়। মোট আমদানি মূল্য এবং সরকারের নির্ধারিত কৃষক পর্যায়ের বিক্রয় মূল্যের পার্থক্য সরকার ভর্তুকি/ট্রেড গ্যাপ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পরিশোধের রীতি প্রচলিত আছে। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেসরকারি পর্যায়ের আমদানিকৃত নন-ইউরিয়া (টিএসপি, ডিএপি, এমওপি ও এমএপি) সারের ভর্তুকি বিল যথাসময়ে আমদানিকারকরা পায়নি। এ কারণে আমদানিকারকরা সার আমদানির জন্য যেসব ব্যাংকে ঋণপত্র বা এলসি খুলেছে ওইসব ব্যাংকের ভর্তুকির বিল পরিশোধ সম্ভব হয়নি। তাই এমন পরিস্থিতিতে যেসব আমদানিকারক ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি তাদের ঋণপত্র খোলা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে আমদানিকারকদের ব্যাংক হিসাব শ্রেণিবিন্যস্ত বা খেলাপি না করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানায় কৃষি মন্ত্রণালয়।

জানা যায়, বেসরকারি খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানিকৃত সারের বিপরীতে এখনও প্রায় ৫ হাজার ১৬ কোটি ৭১ লাখ ১৬ হাজার টাকা বকেয়া রয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএ) কৃষি মন্ত্রণালয়কেও একটি চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, বেসরকারি খাতের সার আমদানিকারকরা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ভর্তুকি বাবদ টাকা পায়। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় যথাসময়ে সে অর্থ ছাড় করেনি, যার কারণে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না আমদানিকারকরা। এমন পরিস্থিতিতে আমদানিকারকদের ব্যাংক হিসাব যাতে শ্রেণিবিন্যস্ত বা খেলাপি না করা হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএফএ-র ভাইস প্রেসিডেন্ট সাইফুদ্দিন মাহমুদ শেয়ার বিজকে বলেন, আমাদের সংগঠন থেকে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়কে। যেহেতু অর্থ মন্ত্রণালয় ভর্তুকির টাকা ছাড় করেনি, তাই আমরা ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করতে পারিনি। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক যাতে আমাদের ঋণখেলাপি না করে তার আবেদন করে চিঠি দিয়েছি। তবে চিঠি দেয়ার পর এখন পর্যন্ত কোনো আপডেট পাইনি।

তিনি আরও বলেন, সাধারণত অন্যান্য সময় টাকা পেতে চার থেকে ছয় সময় লাগত। কিন্তু এবার দেড় বছর হয়ে গেছে, এখনও টাকা পাইনি।

জানা যায়, সার আমদানির ক্ষেত্রে ছয় মাস ও এক বছর পর্যন্ত ডেফার্ড পেমেন্টের সময় পায় আমদানিকারকরা। যদি এ সময়ের মধ্যে তারা ঋণ পরিশোধ করতে না পরে তখন ওই আমদানিকারককে খেলাপি করে দেয়া হয়। মূলত অর্থ মন্ত্রণালয়ের ছাড়কৃত অর্থ দিয়ে ব্যাংকের পেমেন্ট করে থাকে আমদানিকারকরা।

জানা গেছে, নন-ইউরিয়া সারের ৬০ শতাংশ সরকার বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের

(বিএডিসি) মাধ্যমে আমদানি করে ডিলারদের মাধ্যমে বাজারজাত করে। ৪০ শতাংশ সার ভর্তুকির মাধ্যমে বেসরকারি খাতে আমদানি করা হয়, যা পরবর্তীকালে ডিলারদের মাধ্যমে কৃষকের কাছে সরবরাহ করা হয়।

অন্যদিকে সারের ভর্তুকি বাবদ সরকারের কাছে গত জুন পর্যন্ত বকেয়া ৮ হাজার কোটি টাকা পাচ্ছে না রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। যথাসময়ে টাকা পরিশোধ করতে না পারায় সরকারি চার ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৬৭ কোটি টাকায়। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলো ইউরিয়া সার আমদানির নতুন আমদানি এলসি খুলতে চাচ্ছে না।

এলসি খুললেও ডলার সংকটের কারণে বিদেশে যথাসময়ে মূল্য পরিশোধ করতে পারছে না। এতে এসব ব্যাংকের এলসির বিপরীতে বিদেশি ব্যাংক নিশ্চয়তা দিতে (অ্যাড কনফরমেশন) রাজি হচ্ছে না। সব মিলিয়ে আমদানির কার্যক্রম পিছিয়ে যাচ্ছে, যা আসন্ন বোরো মৌসুমে কৃষকদের সার সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।

এ পরিস্থিতি নিরসন অতি জরুরি উল্লেখ করে সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দিয়েছেন বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান। চিঠির অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে দেয়া হয়েছে।

দেশে ইউরিয়া সারের চাহিদার একটি অংশ বিসিআইসি নিজস্ব কারখানায় উৎপাদন করে। অবশিষ্ট সার কাফকোর কাছ থেকে কেনে ও সরকারিভাবে জিটুজি পদ্ধতিতে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে প্রতিষ্ঠানটি। পরে ভর্তুকি মূল্যে কৃষকদের কাছে সার বিক্রি করে। ভর্তুকির অর্থ বিসিআইসিকে পরিশোধ করে সরকার। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে অর্থ না পাওয়ায় এ সংকট দেখা দিয়েছে।

বিসিআইসি জানিয়েছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জিটুজি চুক্তির আওতায় ৯ লাখ টন ইউরিয়া সার আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে ৩ লাখ ৩০ হাজার টন, কাতার থেকে ৩ লাখ টন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২ লাখ ৭০ হাজার টন সার আমদানি করা হবে। এসব দেশ থেকে ইতোমধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার টন আমদানি করা হয়েছে। গত নভেম্বরে ও চলতি মাসে দেড় লাখ টন এবং জানুয়ারিতে ১ লাখ ৮০ হাজার টন, ফেব্রুয়ারিতে দেড় লাখ টন এবং মার্চে ৯ হাজার টন আমদানির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। আমদানির মূল্য বাবদ পাঁচ মাসে ৩২ কোটি ৪০ লাখ ডলার প্রয়োজন।

চলতি অর্থবছরে মোট ২৭ লাখ টন ইউরিয়া সারের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ডিসেম্বরে ইউরিয়া সারের চাহিদা ৩ লাখ ১৮ হাজার টন, জানুয়ারিতে চাহিদা ৪ লাখ ২৩ হাজার টন, ফেব্রুয়ারিতে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টন এবং মার্চে চাহিদা ২ লাখ ৪৭ হাজার টন। বিসিআইসি বলছে, চাহিদা বিবেচনায় মৌসুমে সার বিতরণের জন্য জিটুজি উৎসের সারের সরবরাহ অক্ষুণ্ন রাখতে যথাসময়ে এলসি খোলা ও এলসির মূল্য পরিশোধের কোনো বিকল্প নেই। সারের মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে ডলার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে ভর্তুকির অর্থ জরুরি ভিত্তিতে ছাড় করতে হবে।