সার প্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা দক্ষিণের ছয় জেলায়

মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর : কভিড মহামারির বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে অর্থনীতিবিদরা আগামী বছরে সারাবিশ্বে খাদ্য সংকটের পূর্বাভাস দিয়েছেন। এ নিয়ে বাংলাদেশেও খাদ্য উৎপাদনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশবাসীকে নিজ নিজ জমিতে চাষাবাদের অনুরোধ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সংকটকালে চলতি রবি ও আগামী বোরো ফসলে সারের চাহিদা মেটানো কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে যশোরসহ দক্ষিণাঞ্চলের ছয় জেলার চাষি ও ডিলারদের মাঝে।

চাষিরা বলছেন, যুদ্ধের কারণে সদ্য সমাপ্ত আমন চাষে সার সংকট দেখা দিলেও তা সামাল দেয়া সম্ভব হয়েছে। তবে রবি ও বোরো আবাদের জন্য চাহিদার চেয়ে কম বরাদ্দ দেয়ার মতো পরিস্থিতিতে সামনে বোরো আবাদের জন্য সারের বড় চাহিদা কতটা মিটানো সম্ভব হবে, তা নিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। যদিও কৃষি বিভাগ বলছে, রবি ও বোরো আবাদ টার্গেট করে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে, যে কারণে এ দুটি আবাদ কোনো সংকট ছাড়াই নিরবিচ্ছিন্নভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যশোর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, আগামী বোরো মৌসুমে যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলার জন্য হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয় জাতের তিন লাখ ৮১ হাজার ১০ হেক্টর জমিতে ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর বাইরেও বিপুল জমিতে শীতকালীন সবজি, গম, আলু, সরষে, বাদাম, ভুট্টা, মসুর, ছোলা ও মাষকলাই আবাদ হয়ে আসছে। এসব জমির ফসল চাষে বিপুল রাসায়নিক সার প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত রবি ও বোরো মৌসুমে সার ব্যবহার হয় সর্বোচ্চ। বিশেষ করে বোরো আবাদের জন্য সারের চাহিদা রয়েছে বেশি। তবে এ বছর আমন মৌসুমে সারের সংকট দেখা দেয়ায় সামনের বোরো আবাদ নিয়ে কৃষককে ভাবিয়ে তুলছে। তারা দাবি করছেন, সামনে চাষের উপযুক্ত সময়ে যদি সার সরবরাহ সঠিক না থাকে, তাহলে বোরো আবাদে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে, যা দেশের খাদ্য উৎপাদনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।

কৃষি বিভাগের সূত্রে জানা গেছে, চলতি রবি ও আগামী বোরো মৌসুম টার্গেট করে আগামী ডিসেম্বর মাসে দক্ষিণের ছয় জেলার জন্য যে পরিমাণ সারের চাহিদা দেয়া হয়, তার মধ্যে রয়েছে ইউরিয়া ৪৬ হাজার ৪৬৩ মেট্রিক টন। টিএসপি, ২৪ হাজার ৯০৭ মেট্রিক টন, ডিএপি ৩২ হাজার ৫৮১ মেট্রিক টন এবং এমওপি ২৮ হাজার ৭৮২ মেট্রিক টন।

চাহিদার বিপরীতে ডিসেম্বর মাসে এ ছয় জেলার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ইউরিয়া ২৮ হাজার ৮৪৪ মেট্রিক টন, টিএসপি ১২ হাজার ৯৬০ মেট্রিক টন, ডিএপি ২৭ হাজার ৯৬৩ মেট্রিক টন ও এমওপি ১২ হাজার ৪১২ মেট্রিক টন।

অন্যদিকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে চাহিদা দেয়া হয় ইউরিয়া ৭৩ হাজার ৩২ মেট্রিক টন, টিএসপি ২৬ হাজার ৪৭৫ মেট্রিক টন, ডিএপি ৩৪ হাজার ৩১৫ মেট্রিক টন ও এমওপি ২৮ হাজার ৬৮৬ মেট্রিক টন। অথচ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ইউরিয়া ৪৫ হাজার ৩৫৪ মেট্রিক টন, টিএসপি, ১৪ হাজার ৩৭০ মেট্রিক টন, ডিএপি ৩০ হাজার ৩৫০ মেট্রিক টন ও এমওপি ১৪ হাজার ৩০১ মেট্রিক টন।

আর ফেব্রুয়ারি মাসের চাহিদা দেয়া হয়, ইউরিয়া ৭৬ হাজার ৪৪৩ মেট্রিক টন, টিএসপি ১৯ হাজার ৩০৯ মেট্রিক টন, ডিএপি ২৫ হাজার ৭৭৮ মেট্রিক টন ও এমওপি ২৩ হাজার ৭১৯ মেট্রিক টন। অথচ এর বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ইউরিয়া ৫৫ হাজার ৫২৬ মেট্রিক টন, টিএসপি ১০ হাজার ৭৭৫ মেট্রিক টন, ডিএপি ১৮ হাজার ১৬৮ মেট্রিক টন ও এমওপি ৭ হাজার ৪৬১ মেট্রিক টন।

যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০ নভেম্বর পর্যন্ত যশোরের ডিলার পর্যায়ে যে পরিমাণ সার মজুত রয়েছে, তার মধ্যে ইউরিয়া এক হাজার ১৮৬ মেট্রিক টন, টিএসপি ৫৯৮ মেট্রিক টন, ডিএপি এক হাজার ৬১১ মেট্রিক টন ও এমওপি এক হাজার ২৮৯ মেট্রিক টন রয়েছে। বরাদ্দ দেয়া সার প্রাপ্তির ওপরই ভরসা করছে এ জেলার ডিলাররা।

তবে এ মুহূর্তে যশোর বাদে বাকি পাঁচ জেলায় কী পরিমাণ সার মজুত আছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে পারেনি যশোরাঞ্চলের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয়।

এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মঞ্জুরুল হক বলেন, এ অঞ্চলের আওতাভুক্ত ছয় জেলার জন্য যে সার মজুত আছে এবং সামনে পাইপলাইনে যে সার রয়েছে, তাতে আগামীতে কোনো সংকট হবে বলে আমরা মনে করছি না। সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বোরো আবাদসহ সব ধরনের ফসল আবাদের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এজন্য সারের সরবরাহ নিশ্চিত রাখার ক্ষেত্রে সিরিয়াস।

তবে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সার সরবারাহে কোনো সংকট হবে না বলে আশার বাণী শোনালেও কৃষক ও ডিলার পর্যায়ে রয়েছে শঙ্কা। কারণ চলমান ডলার সংকট নিরসন না হওয়ায় আমদানি মূল্যে পরিশোধ না করতে পারলে ১২ লাখ টন ইউরিয়া সার আমদানি অনিশ্চয়তায় পড়বে।
সদর উপজেলার ইছালী গ্রামের কৃষক হাদিউজ্জামান মিলন বলেন, সার বরাদ্দ খাতা-কলমে থাকলেও ডিলারের কাছে গেলে তার সত্যতা মেলে না। গত আমন মৌসুমে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সারের কোনো সংকট নেই বলা হলেও ডিলারের কাছে গিয়ে পাওয়া যায়নি। বাধ্য হয়ে আমাদের বাড়তি দামে সার কিনতে হয়।

একই ধরনের শঙ্কা বিসিআইসি ডিলারদের মাঝেও। এ বিষয়ে চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের সারের ডিলার শামছুল আলম বলেন, কৃষি অফিস থেকে জানানো হয়, সারের কোনো সংকট নেই। আশা করছি বরাদ্দ অনুযায়ী সঠিক সময়ে সার উত্তোলন করতে পারব। তবে এক্ষেত্রে কোনো রকমের হেরফের হলে বোরোসহ সার্বিক ফসল আবাদে প্রভাব পড়বে বলে তিনি দাবি করেন।

উল্লেখ্য, ডলার সংকটের কারণে সারসহ জরুরি বিভিন্ন পণ্য আমদানি যাতে ব্যাহত না হয়, সেজন্য গত ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ সচিবসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ নির্বাহীদের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০