রহমত রহমান: দেশে প্রতিনিয়ত ধূমপায়ী ও তামাক সেবনকারীর সংখ্যা বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে তামাকজনিত রোগ ও মৃত্যুহার। তামাক সেবন প্রত্যাশিত মাত্রায় হ্রাস না পাওয়ার কারণ হিসেবে তামাকের জটিল কর কাঠামোকে দায়ী করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছর তামাক দ্রব্যের ওপর কর বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল (এনটিসিসি)। প্রস্তাবে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে ‘সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য’ শব্দত্রয় মুদ্রণ বাধ্যতামূলক করা, তামাক কোম্পানির উপকরণ কর রেয়াত বাতিল করা, সিগারেট, বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাকের ক্ষেত্রে সর্বনি¤œ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে ‘সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ’ করাসহ কয়েকটি প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে সিগারেট থেকে বছরে অতিরিক্ত ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব বাড়বে। কমবে সিগারেটের ব্যবহার। একই সঙ্গে বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাক থেকে রাজস্ব বাড়বে ও ব্যবহার কমবে।
এনটিসিসি সমন্বয়নকারী হোসেন আলী খোন্দকার স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত প্রস্তাবনা সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে পাঠানো হয়েছে।
সূত্রমতে, এনটিসিসি আইন সংশোধন করে সিগারেটের প্যাকেটে ‘বিক্রয়মূল্য বা খুচরা মূল্য’ এর স্থলে ‘সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য’ মুদ্রণ বাধ্যতামূল করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়, মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ এর ৫৮ ও ১৩৫ ধারায় বলা হয়েছে, উৎপাদিত বা আমদানি করা সিগারেটের মূল্য নির্ধারণসহ প্যাকেটে স্ট্যাম্প বা ব্যান্ডরোল ব্যবহার পদ্ধতি বিধিমালা, ২০১৯ এর ৫(১) বিধিতে সিগারেটের ‘সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য’ নির্ধারণের বিধান রয়েছে। এই আইন অনুযায়ী এনবিআর ২০২০ ও ২০২২ (সংশোধিত) আদেশ (এসআরও) জারি করেছে। যাতে স্তরভিত্তিক সিগারেট, বিড়ি, জর্দা ও গুলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে কৌশলে ‘সর্বোচ্চ’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘বিক্রয়মূল্য বা খুচরা মূল্য’ লেখা হয়। যার মাধ্যমে তামাক কোম্পানিগুলো অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, সিগারেট কোম্পানিগুলো প্রভাব খাটিয়ে এসআরও থেকে ‘সর্বোচ্চ’ শব্দ বাদ দেয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। অন্যদিকে ওজন ও পরিমাপ মানদণ্ড আইন, ২০১২ অনুযায়ী মোড়কজাত পণ্যের মোড়কের গায়ে ‘সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয়মূল্য’ মুদ্রিত থাকা বাধ্যতামূলক। সে জন্য সিগারেটের গায়ে ‘সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য’ লেখা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আরও বলা হয়, তামাক কোম্পানিগুলো মোড়কে বা প্যাকেটে শুধু ‘খুচরা মূল্য’ লিখছে, যা আইন ও বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এই সুযোগ নিয়ে কোম্পানিগুলো ‘খুচরা মূল্যে’ সিগারেট বিক্রি করছে। ফলে খুচরা বিক্রেতা প্যাকেটে মুদ্রিত খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি করে অধিক মুনাফা করছে। আর অতিরিক্ত দামে বিক্রি করা অর্থের ওপর সরকার কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না। হিসাব অনুযায়ী, অতিরিক্ত দামে বিক্রির ওপর সরকার বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। ‘সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য’ উল্লেখ করলে তামাক কোম্পানি আইন অমান্য করা হলে শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হবে।
অন্যদিকে, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছর সিগারেট, বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাকের কর ব্যবস্থা পুনর্গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল। সিগারেটের ক্ষেত্রে সব ব্র্যান্ডে অভিন্ন করভার (এক্সাইজ অংশ চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৬৫ শতাংশ) এবং মূল্যস্তরভিত্তিক সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। সিগারেটের নি¤œস্তরে প্রতি ১০ শলাকার সর্বনি¤œ খুচরা মূল্য ৫৫ টাকা নির্ধারণ করে ৩৫ টাকা ৭৫ পয়সা ‘সুনির্দিষ্ট সম্পূক শুল্ক’ আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে নিন্মস্তরে সর্বনিন্ম খুচরা মূল্য ৪০ টাকা ও সম্পূরক শুল্ক রয়েছে ৫৭ শতাংশ। একইভাবে মধ্যম স্তরে ১০ শলাকার সর্বনিন্ম খুচরা মূল্য ৭০ টাকা ও সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক ৪৫ টাকা ৫০ পয়সা, উচ্চস্তরে ১০ শলাকার সর্বনিন্ম খুচরা মূল্য ১২০ টাকা ও সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক ৭৮ টাকা এবং প্রিমিয়াম স্তরে খুচরা মূল্য ১৫০ টাকা ও সম্পূরক শুল্ক ৯৭ টাকা ৫০ পয়সা আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া সিগারেটের চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট ও ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বহাল রাখারও প্রস্তাব করা হয়েছে।
সিগারেটের ক্ষেত্রে এনবিআর এই প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করলে রাজস্ব পাবে ৪২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বেশি। অর্থাৎ সিগারেটের রাজস্ব আদায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সিগারেটের ব্যবহার ১৫ দশমিক ১ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ১৩ দশমিক ৯২ শতাংশ হবে। প্রায় ১৪ লাখ প্রাপ্ত বয়স্ক ধূমপান ছেড়ে দেবে, প্রায় ১০ লাখ তরুণ ধূমপান শুরু করতে নিরুৎসাহিত হবে। ৪ লাখ ৮৮ হাজার প্রাপ্ত বয়স্ক ও ৪ লাখ ৯২ হাজার তরুণের তামাক ব্যবহারজনিত অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে।
সূত্রমতে, বর্তমানে সিগারেট বাজারের ৭৩ শতাংশই নি¤œস্তরের সিগারেটের দখলে। এর বাজারের আকার প্রায় প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। নিন্মস্তরে সিগারেটের মূল্য বাড়ানো হলে তুলনামূলকভাবে স্বল্প আয়ের ধূমপায়ীরা ধূমপান ছাড়তে উৎসাহিত হবেন। একই সঙ্গে উচ্চ স্তরগুলোতে সিগারেটের দাম বাড়লে ধূমপায়ীদের সস্তা ব্র্যান্ড বেছে নেয়ার আগ্রহও কমবে বলে প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া মধ্যমেয়াদে ২০২১-২২ অর্থবছর হতে ২০২৫-২৬ অর্থবছর সময়কালে চারটি স্তরভিত্তিক কর প্রথা বিলোপ করে দুইটি স্তরে নামিয়ে আনারও প্রস্তাব করা হয়েছে।
অপরদিকে ফিল্ডারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির সর্বনিন্ম খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক ১১ টাকা ২৫ পয়সা আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে খুচরা মূল্য ১৮ টাকা ও সম্পূরক শুল্ক খুচরা মূল্যের ৩০ শতাংশ নির্ধারিত রয়েছে। এছাড়া ফিল্ডারযুক্ত ২০ শলাকা বিড়ির সর্বনি¤œ খুচরা মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করে ৯ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কের হার হবে চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৪৫ শতাংশ। ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্যের (জর্দা ও গুল) প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার সর্বনি¤œ খুচরা মূল্য ৪৫ টাকা নির্ধারণ করে ২৭ টাকা ‘সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক’ আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। আর প্রতি ১০ গ্রাম গুলের সর্বনি¤œ খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কের হার হবে চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৬০ শতাংশ। ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ১ শতাংশ স্বাস্থ্য সারচার্জ বহাল থাকবে।
সূত্রমতে, মূসক আইনের ৪৬ ধারা সংশোধন করে তামাক কোম্পানিকে উপকরণ কর রেয়াত নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এই রেয়াত নেয়া যুক্তি সঙ্গত নয়। আইন সংশোধন করে রেয়াত নেয়ার সুযোগ বাতিল করা হলে রাজস্ব আয় বাড়বে বলে প্রস্তাবে বলা হয়েছে।