Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 2:23 am

সিঙ্গারের টার্নওভার দেড়হাজার কোটি টাকা, ভ্যাট মাত্র ৩৩ কোটি!

রহমত রহমান: দীর্ঘদিন থেকেই বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা করছে বহুজাতিক কোম্পানি সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান বিদেশি, ব্যবস্থাপনা পরিচালকও বিদেশি। বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা ভালো, মুনাফাও প্রচুর। করোনা-পূর্ববর্তী ২০১৯ সালেও সিঙ্গার বাংলাদেশ রেকর্ড মুনাফা অর্জন করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সরকারকে প্রাপ্ত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেছে। বাংলাদেশে ব্যবসা করলেও বাংলাদেশের আইনকানুনকে পাত্তা না দিয়ে বছরের পর বছর বিক্রির তথ্য গোপন করে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ-ভ্যাট) অনুসন্ধানে বহুজাতিক এই প্রতিষ্ঠানটির ভ্যাট ফাঁকির বিভিন্ন তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

সারাদেশে সিঙ্গারের বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে ৪২৪টি। এর মধ্যে ৩১৪টি কেন্দ্রীয় নিবন্ধনের বাইরে। ১৯টি ওয়্যারহাউসের একটিরও ভ্যাট নিবন্ধন নেই। ফলে নিবন্ধনহীন বিক্রয় কেন্দ্র ও ওয়্যারহাউসের ভ্যাট আত্মসাৎ করা হয়। কোম্পানির বার্ষিক টার্নওভার দেড় হাজার কোটি টাকা হলেও তারা ভ্যাট দিয়েছে মাত্র ৩৩ কোটি টাকা। মাত্র চার মাসে প্রতিষ্ঠানটির ভ্যাট ফাঁকি ও অবৈধ রেয়াত নেয়া হয়েছে প্রায় ৯৪ কোটি টাকা!

সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেডের অনিয়মের এমন সাতকাহনের প্রমাণ পেয়েছে এলটিইউ। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন ও তল্লাশি করে এমন অনিয়মের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

এনবিআর সূত্রমতে, ১৯০৫ সালে বর্তমান বাংলাদেশে ব্যবসা করছে বহুজাতিক আমেরিকান কোম্পানি সিঙ্গার। সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেডের তিনটি মূসক নিবন্ধন রয়েছে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির একটি কারখানা এলটিইউতে নিবন্ধিত। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপ্লায়েন্স লিমিটেড নামে অপর একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা পশ্চিম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে নিবন্ধিত। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয়কেন্দ্র ঢাকা (দক্ষিণ) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে নিবন্ধিত। তিন জায়গায় তিনটি মূসক নিবন্ধন থাকায় সিঙ্গার তিন জায়গায় রিটার্ন দাখিল করে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট ও রেয়াত জালিয়াতি, নিবন্ধনহীন বিক্রয়কেন্দ্র ও ওয়্যারহাউস পরিচালনা করে আসছে বলে অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয় এলটিইউ। এরই অংশ হিসেবে দুটি দল গঠন করা হয়।

২৫ মে একটি দল প্রতিষ্ঠানটির সাভারের গেন্ডা এলাকার গেন্ডা ওয়্যারহাউস এবং অপর একটি দল ঢাকার ফুলবাড়িয়া ওয়্যারহাউসে অভিযান পরিচালনা করেন। দুটি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও তল্লাশি করে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও ভ্যাটসংক্রান্ত দলিলাদি জব্দ করা হয়। এসব দলিলাদি যাচাই করে একই প্রতিষ্ঠানের একাধিক জায়গায় অবৈধ রেয়াত গ্রহণ, বিক্রির বিপরীতের ভ্যাট ফাঁকির চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। ১৪ জুন প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করে এলটিইউ, যাতে ভ্যাট ফাঁকি ও অবৈধ রেয়াত গ্রহণের পরিমাণ প্রায় ৯৪ কোটি টাকা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল ও মে এই চার মাসে বিক্রির বিপরীতে ভ্যাট ও অবৈধ রেয়াত নেয়ার মাধ্যমে এই ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

অন্যদিকে এলটিইউয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিঙ্গার বাংলাদেশের তিনটি মূসক নিবন্ধন রয়েছে। এর মধ্যে সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেডের একটি কারখানা (জামুর, রাজফুলবাড়িয়া, সাভার) এলটিইউয়ের অধিক্ষেত্রাধীন। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপ্লায়েন্স লিমিটেড নামে অন্য একটি কারখানা ঢাকা (পশ্চিম) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে নিবন্ধিত। কেন্দ্রীয় নিবন্ধনের আওতায় প্রতিষ্ঠানটির ১১০টি বিক্রয়কেন্দ্র ঢাকা (দক্ষিণ) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে নিবন্ধিত। তবে পরিদর্শনে জব্দ করা দলিলাদিতে সিঙ্গার বাংলাদেশের ওয়্যারহাউস ও বিক্রয়কেন্দ্রের তালিকা পান ভ্যাট কর্মকর্তারা, যাতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ৪২৪টি। কিন্তু ঢাকা (দক্ষিণ) কমিশনারেটের আওতাধীন মতিঝিল বিভাগে কেন্দ্রীয় নিবন্ধনে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা দেখানো হয়েছে ১১০টি। বাকি ৩১৪টি বিক্রয়কেন্দ্র মূসক নিবন্ধনের আওতাবহির্ভূত। অর্থাৎ এসব বিক্রয়কেন্দ্রে ভ্যাট আদায় করা হলেও তা সরকার পায় না। এছাড়া পরিদর্শনে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির ১৯টি ওয়্যারহাউস রয়েছে, যার দুটি ভ্যাট কর্মকর্তারা পরিদর্শন করেছেন। এই ১৯টি ওয়্যারহাউসও মূসক নিবন্ধনের বাইরে রয়েছে। সিঙ্গার বাংলাদেশ বাংলাদেশে কিছু পণ্য উৎপাদন করে, কিছু পণ্য সিঙ্গারের অন্য দেশের কারখানা আমদানি করে। উৎপাদন ও আমদানির পর পণ্যগুলো এসব ওয়্যারহাউসে রাখা হয়। এসব পণ্য ওয়্যারহাউস থেকে বিক্রয়কেন্দ্রে নিয়ে বিক্রি করা হয়। আবার ওয়্যারহাউস থেকে ডিলার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি ও সরবরাহ করা হয়। এই ওয়্যারহাউস থেকে পণ্য সরবরাহে কোনো ভ্যাট দেয় না সিঙ্গার বাংলাদেশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, যেহেতু এসব বিক্রয়কেন্দ্র ও ওয়্যারহাউস কোনো নিবন্ধনের অন্তর্ভুক্ত নেই, সেহেতু এসব ওয়্যারহাউস ও বিক্রয়কেন্দ্র এলটিইউয়ের অধিক্ষেত্রাধীন এবং ভ্যাট আদায়সহ ন্যায় নির্ণয়ন কার্যক্রম এলটিইউয়ের এখতিয়ারাধীন। এসব বিক্রয়কেন্দ্র ও ওয়্যারহাউস মূসক আইন লঙ্ঘন করে পরিচালনা করা হচ্ছে। এলটিইউ এসব বিক্রয়কেন্দ্র ও ওয়্যারহাউসের অনিয়মের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে।

এ বিষয়ে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, বহুজাতিক কোম্পানি সিঙ্গার যে অনিয়ম করেছে, তাতে মূসক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা উচিত। এনবিআর বিবেচনা করে এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক টার্নওভার প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ওপরে। টার্নওভার অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি বছরে কয়েকশ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে আসছে।

এ বিষয়ে সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) আকরাম উদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এলটিইউ ভ্যাট ফাঁকির যে মামলা করেছে, সে সম্পর্কে জানি না। আমরা কোনো চিঠি বা নোটিস পাইনি।’ ৩১৪টি বিক্রয়কেন্দ্রের নিবন্ধনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের একটি নিবন্ধন এলটিইউতে, অপরটি ভ্যাট দক্ষিণের অধীন মতিঝিল বিভাগে। সব বিক্রয়কেন্দ্রের নিবন্ধন মতিঝিল বিভাগে রয়েছে; এলটিইউ এ বিষয়ে জানে না। মতিঝিল বিভাগে গিয়ে দেখতে পারেন।’

১৯টি ওয়্যারহাউসের নিবন্ধন নেই এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এলটিইউতে আমাদের ফ্যাক্টরি নিবন্ধিত। আমাদের তো ট্রেডিং ও ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট রয়েছে। সব জায়গায় ভ্যাট কাটা হয়।  এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা টার্নওভার হলেও এলটিইউ ও দুটি কমিশনারেটে গত বছর মাত্র ৩৩ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছে সিঙ্গার এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা হলে তো সরকার বসে থাকত না। জালিয়াতি করলে কি এনবিআর ছেড়ে দিত। এলটিইউ সিঙ্গারকে বাটা, অ্যাপেক্সের মতো করে চিন্তা করে। আমরা তো পোর্ট স্টেজে ভ্যাট দিই। বিক্রিতে ভ্যাট দিই। এলটিইউ আমাদের বলেছে পণ্যের দাম বাড়াতে। সেটা কি সম্ভব? ভ্যাট ও রেয়াত ফাঁকি হবে কেন? তাদের ক্যালকুলেশনে কোনো প্রবলেম হয়েছে।’