সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: একাধিক ব্যাংকে খেলাপি মাবিয়া গ্রুপের প্রধান ব্যবসা ছিল স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি, জাহাজ ভাঙা এবং ইস্পাত উৎপাদন। কিন্তু ব্যবসায়িক ব্যর্থতায় ব্যাংক খাতে অন্যতম শীর্ষ ঋণখেলাপি গ্রুপগুলোর পরিণত হয় মাবিয়া। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় সব বন্ধ হয়ে পড়েছে। এমনকি খেলাপি ঋণের দায়ে মাবিয়া গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম কারাবাস করছেন। এর মধ্যে সিটি ব্যাংকের বন্ধকিতে থাকা খেলাপি পাওনা আদায়ে মাবিয়া ব্রেকার্সের জমি নিলামে বিক্রয়ের উদ্যোগ নিয়েছে।
সিটি ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ব্যবসার প্রয়োজনে সীতাকুণ্ডের জাহানারাবাদ এলাকার মহরম আলী মেম্বারের সন্তান জাহাঙ্গীর আলম একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ সুবিধা নেন, যিনি মাবিয়া গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এ গ্রুপের মাবিয়া স্টিল কমপ্লেক্স এবং মাবিয়া শিপ ব্রেকার্স ইত্যাদি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে সিটি ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করে। এ দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির সুদাসলে পাওনা প্রায় ১ কোটি টাকা। আর তা অনাদায়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অর্থঋণ আদালতে মামলা করে, যা চলমান আছে। এর মধ্যে আদালতের অনুমতি নিয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মাবিয়া শিপব্রেকার্সের ঋণের বিপরীতে পাওনা আদায়ে ৫১৮ শতক বন্ধকি জমি বিক্রয়ের উদ্যোগ নিয়েছে। এসব জমিগুলো সীতাকুণ্ড উপজেলার মধ্যম সোনাইছড়ি ও খেশবপুর মৌজায় অবস্থিত। আগ্রহী ক্রেতাদের আগামী ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা স্পেশাল অ্যাসেট ডিভিশনে দরপত্র জমা দেয়ার আহ্বান করা হয়।
এদিকে গত ৭ নভেম্বর মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড মাদাম বিবিরহাট শাখার ৭ কোটি টাকার চেক প্রতারণার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত মাবিয়া গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। ৭ নভেম্বর বিকালে চট্টগ্রাম যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আবু সালেহ মোহাম্মদ নোমানের আদালত কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এর আগে ৬ নভেম্বর দিবাগত রাতে নগরের পাঁচলাইশ থানা এলাকা থেকে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমকে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে সীতাকুণ্ড থানায় হন্তান্তর করেন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত কারাগারে আছেন এ ব্যবসায়ী।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সূত্রে, সীতাকুণ্ডের জাহানারাবাদ এলাকার মহরম আলীর তিন সন্তান জাহাঙ্গীর আলম, ফরিদুল আলম ও খোরশেদ আলমÑএ তিন সহোদর ২০০৮ সালের পর একে একে গড়ে তোলেন মেসার্স জিলানী ট্রেডার্স, ফাহিম স্টিল রি-রোলিং মিল, মাবিয়া স্টিল কমপ্লেক্স এবং ব্রাদার্স ইস্পাত ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড মাবিয়া শিপ ব্রেকার্স, মাবিয়া শিপ ব্রেকার্স ইউনিট-২, এফএমএস ইস্পাত শিপ ব্রেকিং, আলী স্টিল এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স খাজা আজমীর করপোরেশনের সমন্বয়ে গড়ে তুলে মাবিয়া গ্রুপ। সময়ের সঙ্গে আস্তে আস্তে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে থাকেন। কিন্তু তাদের অদূরদর্শী প্রকল্প গ্রহণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও ব্যবসায়িক অনভিজ্ঞতার ইত্যাদি বিবেচনা না করে দি সিটি ব্যাংক, এবি ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা প্রায় ৮০০ কোটি টাকা, যা এখন গলার কাঁটা হয়ে আছে সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য।
ঋণের টাকা ফেরত পেতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চেক প্রত্যাখ্যানের জন্য এন আই অ্যাক্ট ও অর্থঋণ আদালতে অর্ধশতাধিক মামলা করে, যা চলমান আছে। এর মধ্যে সিটি ব্যাংকে খেলাপি পাওনা ১৬১ কোটি টাকা, এবি ব্যাংকে ১২০ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ১২১ কোটি টাকা, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ১১০ কোটি টাকা, ফার্স্ট ফাইন্যান্সে প্রায় ৫০ কোটি টাকা, ফিনিক্স ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টেরও ৯ কোটি টাকাসহ পূবালী, রূপালী ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি। আর এ পাওনা আদায়ে অনেকবার চেষ্টা করা হলেও ব্যর্থ হতে হয় প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের। তার আরেক ভাই ফরিদুল আলম পদ্মা ব্যাংক লিমিটেডে ৩৩ কোটি টাকা খেলাপি।
এ বিষয়ে সিটি ব্যাংক লিমিটেডের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মাবিয়া গ্রুপের একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে নেয়া ঋণ এখন খেলাপি। এর মধ্যে আদালতের অনুমতি নিয়ে সীতাকুণ্ড উপজেলায় মাধ্যম সোনাইছড়ি ও কেশবপুরের ৫১৮ শতক জমি নিলামে বিক্রয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নিলাম আহ্বানও করা হয়েছে। যদিও এর আগে খেলাপি পাওনা আদায়ে নিলামে বিক্রয়ে চেষ্টা করেছি। যদিও কিছু হয়নি। তবে এবার আশা করছি ক্রেতা পাওয়া যাবে। আর পাওনা আদায়ে আমরা আইন অনুসারে কাজ করছি। এছাড়া মাবিয়া গ্রুপের এমডি জাহাঙ্গীর আলম অন্য ব্যাংকের মামলায় এখন জেলে আছেন। তাদের অনেক জমি ও সম্পদ আছে। কিছু কিছু জমি বিক্রয় করলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ শোধ করতে পারবে। কিন্তু তারা তা করছে না।’
মাবিয়া গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহাঙ্গীর আলমের কারাগারে থাকায় মন্তব্য নেয়া যায়নি।