সর্বস্বান্ত এক উদ্যোক্তা

পলাশ শরিফ: সিটি ব্যাংকের বেনামি এক ঋণে সর্বস্বান্ত হয়েছেন এক উদ্যোক্তা। কিন্তু লাভবান হয়েছেন ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ১১ কর্মকর্তা। ঋণটি দিয়ে ব্যাংকের ১৭৫ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে; খেলাপি বেড়েছে ১২০ কোটি টাকা। কিন্তু রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকা নেওয়ায় বড় এ কেলেঙ্কারি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মুখে কুলুপ এঁটেছেন সিটি ব্যাংকের পর্ষদসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা।

লাকি শিপ বিল্ডার্স নামক এক প্রতিষ্ঠানের সব কাগজপত্র জাল করে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে অভিনব কৌশলে ১৬৪ কোটি টাকা ঋণ দেয় সিটি ব্যাংক। ২০১২ সালে তৎকালীন চেয়ারম্যান রুবেল আজিজের নির্দেশে সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ সাত্তার ঋণটি অনুমোদন করেন। আর এ প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেন বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হোসেন, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক মাঈন উদ্দিন, সাবেক ডিএমডি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সাবেক ব্যবস্থাপক মনিরুদ্দিন আহমদ। ব্যাংকটির ১১ জন দায়িত্বশীল পরিচালক-কর্মকর্তার যোগসাজশে এ ঋণ দেওয়া হয়। শুধু লাকি শিপ বিল্ডার্স নয়, এ সময়ে মোট আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দেখিয়ে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আর এ কাজে সহযোগিতার কারণে প্রায় সব কর্মকর্তার পদোন্নতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তা লাকি শিপ বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম কাওসারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুদকে একটি মামলা হলেও এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

তথ্যমতে, লাকি শিপ বিল্ডার্সের নামে দীর্ঘমেয়াদি শিল্পসহ বিভিন্ন ঋণ দেখানো হলেও প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানটির মূল মালিকের হাতে ছিল না। ঋণ দেওয়ার আগে ওই প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছিল সিটি ব্যাংক। এরপর ‘সিগ্নেটরি’ হিসেবে চেয়ারম্যান রুবেল আজিজের ভায়রা ফজল উল্লাহ কাদরী ও পারটেক্স গ্রুপের দুই কর্মকর্তাকে ওই অ্যাকাউন্ট পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এরপর ওই ঋণের অর্থ রুবেল আজিজ ও তার স্ত্রী-স্বজনদের মালিকানাধীন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ কারণে শীর্ষ খেলাপির তালিকায় নাম এসেছে প্রতিষ্ঠানটির। অন্যদিকে খেলাপি ঋণের দোহাই দিয়ে লাকি শিপ বিল্ডার্সের সম্পত্তিও নিলামে বিক্রি করেছে সিটি ব্যাংক। এতে ব্যবসায়িকভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে লাকি শিপ বিল্ডার্স।

তথ্যমতে, ব্যাংকের জালিয়াতির তথ্য জানার পর বেনামি ঋণ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে আবেদন করেন লাকি শিপ বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম কাওসার। এর পরিপ্রেক্ষিতে এ ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ আমলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দেয়। তদন্তে লাকি শিপ বিল্ডার্সসহ আটটি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা ঋণের নামে সেই অর্থ ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান রুবেল আজিজ ও স্ত্রী শেহরীন আজিজ এবং তাদের আত্মীয়স্বজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নেওয়ার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ এ ঋণ জালিয়াতির বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন পর্যন্ত গড়িয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ওই জালিয়াতির ঘটনা খতিয়ে দেখছে দুদক। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এ জালিয়াতির জন্য প্রায় ৩০ জনকে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি।

জানা গেছে, ঋণ জালিয়াতির ঘটনা খতিয়ে দেখছে দুদক। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এ জালিয়াতির জন্য প্রায় ৩০ জনকে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি। এরই মধ্যে কয়েকজনকে তলব-জিজ্ঞাসাবাদও করেছে দুদক।
এদিকে বহুল আলোচিত জালিয়াতির ঘটনায় সিটি ব্যাংকের পরিচালক রুবেল আজিজ, শেহরীন আজিজ, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ সাত্তার, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হোসেন, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক মাঈন উদ্দিন, সাবেক ডিএমডি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ডিএমডি আবদুল ওয়াদুদ, ব্যবস্থাপক মনিরুদ্দিন আহমদ, সহকারী ব্যবস্থাপক আলী আল ইরফান এবং ব্যাংকটির আইন ও রিকভারি শাখার তিনজনসহ দায়িত্বশীল ১১ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে। তবে ব্যাংকের তরফে আজ পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ সাত্তার ও সাবেক ডিএমডি বদরুদ্দোজা চৌধুরী চাকরি ছেড়েছেন। সম্প্রতি সিটি ব্যাংকের সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক মাঈন উদ্দিনও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ট্রাস্ট ব্যাংকে যোগ দিয়েছেন। অন্যদিকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হোসেনসহ জালিয়াতিতে অভিযুক্ত ছয় কর্মকর্তা এখনও কর্মরত আছেন। গত চার বছরে সবাই পদোন্নতিসহ বাড়তি সুবিধা পেয়েছেন।

তবে সিটি ব্যাংকের দায়িত্বশীল কেউ-ই এ জালিয়াতি সম্পর্কে মুখ খুলতে রাজি হননি। কথা বলার জন্য সেলফোনে কয়েক দফায় যোগাযোগ করা হলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হোসেন ‘মিটিং’-এর অজুহাত দিয়ে ফোন ধরেননি। পরে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মুখপাত্র মাসরুর আরেফিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে ব্যাংকটির ডিএমডি ও প্রধান ঝুঁকি কর্মকর্তা আবদুল ওয়াদুদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। ওই কর্মকর্তা গত ২২ মার্চ সাক্ষাতের কথা বলার অনুরোধ করেন। তবে ২১ মার্চ রাতেই এক ক্ষুদে বার্তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে মিটিংয়ের দোহাই দিয়ে সময় দিতে পারছেন না বলে জানিয়ে দেন। ওইদিনই অফিসের কাজে দেশের বাইরে চলে যান।

অন্যদিকে ব্যাংকটির সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক মাঈন উদ্দিন (বর্তমানে ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক) ও সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারাও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ব্যাংকটির দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, যা ঘটেছে সেটা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশেই হয়েছে, চাকরি হারানোর ভয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি হচ্ছেন না।

এ বিষয়ে ব্যাংকটির পরিচালক হোসাইন খালেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এ বিষয় এখনও বিচার-তদন্তাধীন রয়েছে। তাই এসব নিয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে এ বিষয়ে আমার তেমন ধারণা নেই। আগামী সপ্তাহে আসেন, সবকিছু জানার পর আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করা যায় কিনা ভেবে দেখব।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০