দেশের দ্বিতীয় সংসদ হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের ৮৫টি আসন শূন্য রয়েছে দীর্ঘদিন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টি যেমন অপূর্ণাঙ্গ সিনেট দিয়ে চলছে, তেমনি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে ঘটছে না জনমতের প্রতিফলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট কাদের দিয়ে গঠিত হবে, তার সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে এ প্রতিষ্ঠান-সংক্রান্ত ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে। গতকালের শেয়ার বিজের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কর্তৃপক্ষ এ নির্দেশ পরিপালন করছে না যথাযথভাবে। উপাচার্য অবশ্য মন্তব্য করেছেন, ‘সিনেটের পদগুলো শূন্য থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ লঙ্ঘন হচ্ছে না।’ তার এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের মতো লোকও যথেষ্ট পাওয়া যাবে। এর মাধ্যমে সিনেটের শূন্য আসন পূরণে নির্বাচন আয়োজনে তার আন্তরিকতাহীনতাও স্পষ্ট হয় বৈকি। অনেকের জানা, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে খোদ কর্তৃপক্ষই উল্লিখিত অধ্যাদেশটির উদাহরণ দিয়ে থাকে। তাহলে সিনেট গঠন-সংক্রান্ত নির্দেশনা তারা মানছেন না কেন? প্রশ্ন জাগে, এ নির্দেশ পরিপালন না করার পেছনে কি ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে বর্তমান প্রশাসনের? নাকি এর পেছনে রয়েছে কারও স্বার্থ?
যাদের সমন্বয়ে সিনেট গঠনের কথা বলা হয়েছে, তাদের বাছাইয়ে নির্বাচন আয়োজন অসম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা। এক্ষেত্রে বর্তমান প্রশাসনের যে বেশ ঘাটতি রয়েছে, বিদ্যমান পরিস্থিতি দেখে তা বোঝা যায়। এমন মনোভাব গণতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থী। আমরা মনে করি, দেশের উচ্চশিক্ষার প্রধান প্রতিষ্ঠান পরিচালনা-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব ক্ষেত্রে এ আদর্শ অনুসরণ করা উচিত। এজন্য সিনেটের শূন্য আসনগুলো পূরণে শিগগির নির্বাচন দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে আগ্রহীরা এ প্লাটফর্মে আসার সুযোগ যেমন পাবেন, তেমনি উপযুক্ত ব্যক্তিকে প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টরা লাভ করবেন সিনেটে নিজের বক্তব্য তুলে ধরার সুযোগ। এর মাধ্যমে বিভিন্ন কার্যক্রমে গণতন্ত্রচর্চা ত্বরান্বিত হবে।
সিনেট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম। এখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও পেশার প্রতিনিধি সন্নিবেশ করার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সব স্তরের মানুষের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানো। আসনগুলো খালি থাকায় তাদের আকাক্সক্ষা ও মতের প্রতিফলন যে ঘটছে না, তা সবার জানা। বস্তুত সংশ্লিষ্টরা তাদের বক্তব্য এ পরিষদে তুলে ধরতে না পারায় সমস্যাও সৃষ্টি হচ্ছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। নির্বাচন আয়োজন করে শূন্য আসনগুলো পূরণের মাধ্যমেই কেবল এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব। এজন্য আমরা চাইবো, শিগগির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের নির্বাচন দেওয়া হোক। নীতিনির্ধারণী ফোরামে আসার মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া হোক মতপ্রকাশের সুযোগ। প্রসঙ্গত একটি কথা মনে রাখা দরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার। স্বাধীনতার আগে ও পরে দেশে যেসব গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, প্রায় সব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ অবস্থায় সিংহভাগ আসন ফাঁকা রাখার মাধ্যমে মতপ্রকাশের পথ রুদ্ধ করে এ প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম চলতে পারে না।
বাংলাদেশের প্রথম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মূল্যায়ন করা হয় ভিন্নভাবে। এর কিছু ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে। দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুকরণ করা হয় এ প্রতিষ্ঠানকে। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের নির্দেশনা পরিপালনে গাফিলতির অর্থ হলো, খারাপ উদাহরণ সৃষ্টিতেও এগিয়ে থাকা। এজন্য সিনেট গঠনে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে যেসব নির্দেশনা দেওয়া আছে, তা পরিপালনে কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। ছাত্রপ্রতিনিধি নির্বাচনে যে অচলাবস্থা বিদ্যমান, উদ্যোগ নিতে হবে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যও। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নেতৃত্ব দিতে যেমন দেখেছি, তেমনি আদর্শটি সুসংহত করার ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানটিকে একই ভূমিকায় আমরা দেখতে চাইবো।