মেহেদী হাসান, রাজশাহী: জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণেই বেড়েছে সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। এর সঙ্গে বাড়ছে পোলট্রি পণ্যের দামও। বর্তমানে বাজারে ডিম সাড়ে ১২ টাকা প্রতি পিস, ব্রয়লার মুরগির কেজি ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মধ্যস্বত্বভোগী বা এক শ্রেণির সিন্ডিকেটের কারণে পোলট্রি পণ্যের দাম বাড়ছে। যদিও পোলট্রি খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া এবং সরবরাহ কমের কারণেও দাম বাড়ছে বলে মনে করা হয়।
রাজশাহী পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. এনামুল হক বলেন, পোলট্রি খাদ্যের দাম বাড়ার কারণে রাজশাহীর ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ ডিম পাড়া লেয়ার মুরগির খামার বন্ধ হয়ে গেছে। ব্রয়লারের ৮০ শতাংশ খামার বন্ধ। তারা উৎপাদনে ফিরতে পারেননি। ফলে বাজারে মুরগির টান পড়েছে। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে লেয়ার খামারিরা এখন এক দিন বয়সের বাচ্চা তুলতে শুরু করেছেন; যা উৎপাদনে আসতে সময় লাগবে ১৫০ দিন। এছাড়া খামারিরা যেভাবে লোকসানে ছিলেন নতুন দামে ডিম-মুরগি বিক্রি করে তা পুষিয়ে নিতে পারবেন।
গত ২ বছরের ব্যবধানে দফায় দফায় পোলট্রি খাদ্যের দাম বৃদ্ধি খামারিদের নাজেহাল করে তুলেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত মোট চতুর্থবারের মতো বেড়েছে পোলট্রি খাদ্যের দাম। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের নিবন্ধিত ২৭০টি ফিড মিল তাদের উৎপাদিত খাদ্যের দাম বাড়িয়েছে। প্রতি কেজি খাদ্যে মধ্য মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত দাম বেড়েছে ২ থেকে আড়াই টাকা। ফলে ৫০ কেজির বস্তা ১০০ থেকে ১২০ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে খামারিদের।
খামারিরা বলছেন, করোনাকালের শুরু থেকে প্রতি বস্তা পোলট্রি খাদ্যে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনা শুরুর দিকে ১ হাজার ৮০০ টাকার খাদ্যের বস্তা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২৫০ টাকায়।
রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা এলাকার পোলট্রি খামারি সোহেল রানা জানান, একটা পূর্ণ বয়স্ক ডিম দেয়া লেয়ার মুরগি দিনে ১৮০ থেকে ২২০ গ্রাম খাবার খায়। ৬টি মুরগি খাবার খায় ১ কেজি খাদ্য। আগে ১ কেজি খাবার ৫০ টাকায় পাওয়া যেত অর্থাৎ ৫০ কেজির বস্তা ২ হাজার টাকায় হয়ে যেত। একই খাদ্য এখন কিনতে হচ্ছে ৬৫ থেকে ৬৬ টাকা দরে। আগে প্রতি পিস ডিম উৎপাদনে খরচ হতো ৭ টাকা। আর বিক্রি হতো ৭ টাকা ৯০ পয়সা কিংবা ৮ টাকায়। এখন একই ডিম উৎপাদনে খরচ পড়ছে সাড়ে ৮ টাকার ওপরে। আর বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকায়। ১ হাজার মুরগি খাবার খেলে ১ হাজার ডিম পাওয়া যায় না। ৯০ শতাংশ ডিম পেলে ১ টাকা করে লাভ হয়। এখন যারা বলছেন ডিমের দাম কেন বেড়েছে তাদের কাছে প্রশÑশুধু খাবার খাইয়েই মুরগি পালন সম্ভব? নাকি শ্রমিক, ওষুধ, ভ্যাকসিন, পরিবহন আছে?
দেশের বৃহৎ পোলট্রি ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কাজী ফিডের বিপণন বিভাগের প্রধান সালাউদ্দিন হাওলাদার জানান, বর্তমানে ব্রয়লার স্টার্টার ফিড ৩ হাজার ১৬০ টাকা, ব্রয়লার গ্রোয়ার ৩ হাজার ১৯৫ টাকা, ব্রয়লার পুলেট ৩ হাজার ১৫৫ এবং ব্রয়লার ফিনিশার ৩ হাজার ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে; যা আগে অন্তত ৭০০ টাকা কম ছিল। সবকিছুর দাম বাড়ায় বেড়েছে ডিম-মুরগির দাম। এতে ফিড মিলাররা কিছু করতে পারবেন না। কারণ সবগুলোই বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়।
তিনি বলেন, পোলট্রি সেক্টরে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য রয়েছে। প্রান্তিক খামারিরা এলে কতটা নিরাপদে ব্যবসা করতে পারছেন সে বিষয়ে খোঁজ নেয়া হয়। তাদের অভিযোগ, ডিমের দাম বাজারে বেশি হলেও খামারিদের কাছ থেকে কম দামে কেনা হয়।
জানা যায়, মূলত দামের চাবিটা নাড়ায় হাতেগোনা কয়েকজন। গুটিকয়েক পোলট্রি কোম্পানির কারসাজিতেই হুটহাট দাম বাড়ে আবার কমে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট-বড় পোলট্রি শিল্প গড়ে উঠলেও রাজধানীর টঙ্গী, বোর্ড বাজার, জয়দেবপুর ও গাজীপুরে দেশের সবচেয়ে বড় পোলট্রি শিল্প গড়ে উঠেছে। মূলত এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের বাজার।
এ সিন্ডিকেটে রাজশাহী অঞ্চলের দায়িত্বে রয়েছেন মো. জয়নাল আবেদিন। রাজশাহী শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার পূর্বদিকে জেলার পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নের মোসলেমের মোড়ের একটি আড়তে তিনি বসেন। এ অঞ্চলের খামারিদের কাছ থেকে ডিম আনা হয় তার কাছে। এখান থেকেই ট্রাকভর্তি ডিম যায় ঢাকার বাজারে। জয়নাল আবেদিনের আরেক পরিচয় তিনি পোলট্রি ফিডের ডিলার ও ফিড মিল অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য।
জয়নাল আবেদিন বলেন, ডিমের দাম বাড়ানো-কমানোর দায় আমার কাছে নেই। প্রতিদিন ঢাকা থেকে যে রেট দেয়া হয় খামারিদের কাছে সেই রেটের ৫০ পয়সা কম রাখা হয়। কারণ আমাদের খরচ আছে। যে সিন্ডিকেটের কথা বলা হয় আসলে সে রকম কিছু নেই। তবে বড় বড় কোম্পানি তাদের নিজস্ব উৎপাদিত খাদ্য দিয়ে ডিম ও মুরগি উৎপাদন করে; ফলে তাদের খরচ কম হয়। প্রান্তিক খামারিরা যদি বড় কোম্পানির আগ্রাসনে ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে একচেটিয়া তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে। বর্তমানে তারাই সেটা করছে।