Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 3:52 pm

সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে ধ্বংসপ্রায় রাজশাহীর পোলট্রি শিল্প

জেলা প্রতিনিধি, রাজশাহী: সিন্ডিকেটের কারসাজিতে চলতি বছরের শুরু থেকে আগস্ট পর্যন্ত পোলট্রি খাদ্যের দাম বেড়েছে চার দফা। সেইসঙ্গে বেড়েছে ভ্যাকসিন ও বাচ্চার দাম। অন্যদিকে কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে খামারে শ্রমিকের মজুরি ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণ। ফলে উৎপাদিত পোলট্রি পণ্যের দামে উঠছে না উৎপাদন খরচ। খামারিরা বলছেন, খাদ্যের ডিলার আর ওষুধের দোকানে বকেয়ার পরিমাণে ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে পোলট্রি ব্যবসা। এজন্য সিন্ডিকেটকেই দুষছেন তারা। ইতোমধ্যে রাজশাহীর ৪৫ শতাংশ পোলট্রি মুরগির (ব্রয়লার, লেয়ার ও সোনালি) খামার লোকসানে বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে রাজশাহী পোলট্রি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী জেলার পুঠিয়া, দুর্গাপুর, তানোর ও বাগমারা উপজেলায় দেড় হাজার খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে চরম লোকসান হয়েছে পুঠিয়ার খামারিদের। এ উপজেলায় গত এক বছরে প্রায় ৫০০ ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারি ঋণের দায়ে পথে বসেছেন। পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে মুরগি পালনের শেডগুলো, নষ্ট হচ্ছে লাখ টাকার কাঠামো। লোকসানে পড়া খামারিদের বাড়িবাড়ি কিস্তির জন্য ঘুরছেন বেসরকারি উন্নয়স সংস্থার কর্মীরা।

এ পরিস্থিতির কারণ অনুসন্ধানে খুচরা ও পাইকারি ডিম-মাংস বিক্রেতা, পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা, খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গড়ে উঠেছে পোলট্রি খাদ্যের ডিলার। তারা খামারিদের অর্ধেক টাকা বাকিতে খাদ্য ও একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা সরবরাহ করেন। খামারিরা সেই বাচ্চা কয়েক মাস পালনের পর বিক্রয় উপযোগী হলে ডিলারদের কাছে বিক্রি করে দেন। এতে যা লাভ আসে তা খামারিকে দেয় ডিলার। তবে শর্ত থাকে নির্দিষ্ট ডিলার ছাড়া খাদ্য, ভ্যাকসিন ও খামারের প্রয়োজনীয় পণ্য অন্য কোথাও কিনতে পারবেন না তারা। এ কারণে সরকারি পর্যায়ে বস্তাপ্রতি ৩০ টাকা বাড়লে সিন্ডিকেট বাড়ায় ৭৫ থেকে ৯০ টাকা। অন্যদিকে বাকিতে হওয়ায় খামারি পর্যায়ে খাদ্যের প্রতি বস্তায় বাড়ে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। শুরুতেই ভ্যাকসিনের দাম ও পরিমাণভেদে কয়েকশ টাকা এবং খামার তৈরির উপকরণে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লাভ

তুলে নেয় ডিলার। এছাড়া কোম্পানির এজেন্ট অথবা অনিবন্ধিত ভেটেরিনারি চিকিৎসক অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহার করে খামারিদের পকেট কাটে কৌশলে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিলার ছাড়াও বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারি মালিকদের সিন্ডিকেট রয়েছে। প্রতিপিস সোনালি মুরগির বাচ্চার উৎপাদন খরচ পড়ে ১২ টাকা। একই বাচ্চা খামারিদের হাতে আসা পর্যন্ত দাম বেড়ে হয় ২৫ থেকে ৩৮ টাকা। খামারিরা বলছেন, পোলট্রি শিল্পে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন এই মালিকরা। ডিলারদের সঙ্গে একটা শতাংশ চুক্তিতে খামারি ধরার মিশনে নামে তারা। কাজ করে এলাকাভেদে কিছু এজেন্ট। একবার বাচ্চা খামারে উঠিয়ে দিতে পারলেই তাদের কাজ শেষ। এরপর খামারিদের সারা বছর জোঁকের মতো চুষে খায় ডিলার, ভেটেরিনারি চিকিৎসক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা।

এই ত্রিমুখী সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. এনামুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, এখন কয়েকটি বড় কোম্পানি পোলট্রি খাতে বিনিয়োগ করেছে। তারা ইচ্ছামতো খাদ্যের দাম বাড়ায়। কারণ তারা নিজেরাই খাদ্য, বাচ্চা, মাংস ও ডিম উৎপাদন করে। আর এর বাইরে যেসব খামারি থাকেন তাদের ডিলাররা চুষে খায়। বছরে দুবার মুরগির মাংস ও ডিমের দাম বাড়ায় তারা যাতে নতুন খামারি তৈরি হয়।

পুঠিয়ার লেয়ার মুরগির খামারি সৈয়দ আলী শেয়ার বিজকে জানান, তিন বছর আগে ব্যাংকঋণ ও ধারদেনা করে উপজেলা সদর এলাকায় ৭ হাজার ৫০০ লেয়ার মুরগির খামার গড়ে তোলেন তিনি। যখন আশানুরূপ ডিম দেয়া শুরু হয়, তখন ডিমের বাজার পড়ে যায়। ৫০ কেজির বস্তা ১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে বেড়ে ২ হাজার ১০০ টাকা হয়ে যাওয়ায় কয়েক মাস চালিয়ে খামার বন্ধ করতে হয়। এভাবে প্রায় ৩৬ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে তার। তিনি বলেন, আমার মতো এমন অনেক খামারি পথে বসেছেন।

উপজেলার ভালুকগাছি এলাকার জাকির হোসেন বলেন, স্থানীয় এক পোলট্রি ডিলারের পরামর্শে একটি কোম্পানির সঙ্গে ব্রয়লার পালনে চুক্তি করেছি। কোম্পানির চুক্তি মোতাবেক তারা বাচ্চা, খাদ্য ও চিকিৎসা খরচ বহন করে। আমি শুধু খামারে লালন-পালনের কাজ করি। অল্প আয়ে বেঁচে আছি।

ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে কথা হয় দেড় যুগ আগের পোলট্রি পণ্য ডিলার ‘আদর্শ পোলট্রি, ফিশ ও ডেইরি ফিড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএইচএম আরিফুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে আমার আন্ডারে ৮০ থেকে ৯০ হাজার মুরগি পালন করত খামারিরা। এখন ৩০ হাজারে নেমে এসেছে। গতকালও (২২ আগস্ট) প্রতি বস্তায় খাদ্যের দাম ৭৫ টাকা বেড়েছে। দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। ভুট্টা ও সয়ামিলের দাম বাড়েনি।

পোলট্রি ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, গত দেড় বছরে বাচ্চা, খাদ্য, মুরগির চিকিৎসা ও শ্রমিকের মজুরির ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। অথচ মুরগির ডিম বা মাংসের দাম তুলনামূলক কম। এখন আগের মতো মুরগি পালনে তেমন লাভজনক নয়। অনেক খামারি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিতে ব্রয়লার ও সোনালি পালন করছেন। আর হাতেগোনা দু-চারজনের লেয়ার খামার রয়েছে। সবই সিন্ডিকেটের কাজ। জমি বিক্রি করেও টিকতে পারলাম না।

সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ড. জুলফিকার মো. আখতার হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, হঠাৎ চালের দাম বেড়ে গেলে মানুষ বলে সিন্ডিকেটের কাজ। সারাদেশের অবস্থা একই রকম। পোলট্রি খাদ্য তৈরি হয় ঢাকায়, ফিড মিলের সবগুলোই তাদের হাতে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এটি নিয়ন্ত্রণের কোনো উপায় নেই। আমদানি, উৎপাদন ও বিপণন সবকিছুই তাদের হাতে।