সিপিডির সংলাপে বক্তারা: এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী ধকল সামলানো চ্যালেঞ্জ

 

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে আসার জন্য জাতিসংঘ ঘোষিত তিনটি সূচকে এরই মধ্যে বাংলাদেশ উপযুক্ত পয়েন্ট অর্জনে সক্ষম হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে বাকি একটিতেও বাংলাদেশ উত্তরণে সক্ষম হবে। সব মিলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসবে। আর ২০২৭ সালের পর থেকে বাংলাদেশ বৈদেশিক বাজারে যেসব সুযোগ-সুবিধা পায়, সেগুলো আর থাকবে না। তাই ওই সময় অর্থনীতিতে কিছুটা ধাক্কা লাগতে পারে। সে ধাক্কা সামলানো বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। সে পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গুরুত্বপূর্ণ।

এলডিসি থেকে উত্তরণের পথ, চ্যালেঞ্জ নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘বাংলাদেশ অ্যান্ড দ্য এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন চ্যালেঞ্জেস’ শীর্ষক সংলাপে এ কথা বলেন বক্তারা। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে সিপিডি চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র প্রথম সহ-সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।

তারা বলেন, এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে আমাদের স্বল্প সুদে বৈদেশিক সহায়তা, শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধার মতো বিষয়গুলো থাকবে না। কিন্তু এর পাশাপাশি নতুন সম্ভাবনাও তৈরি হবে। এজন্য প্রয়োজন নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি। সে সঙ্গে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে এবং তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর অতিনির্ভরতা কমিয়ে রফতানি বহুমুখীকরণ করতে হবে। অর্থনীতির কাঠামোকে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন করে একটি উন্নততর কাঠামোতে যেতে হবে। এজন্য আমাদের শিল্পায়ন বাড়াতে হবে। কৃষি খাতেও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।

উল্লেখ্য, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও মানব উন্নয়ন সূচকে সক্ষমতা তৈরি করতে পেরেছে বাংলাদেশ। তৃতীয় সূচক, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে উন্নতি করতে হলে আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সে সঙ্গে দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নতি করে প্রচুর পরিমাণ বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে বলে বক্তারা জানান।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, সব মিলিয়ে আমাদের হাতে এখন ১০ বছর সময় রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে আমাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দরকষাকষির সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এটা মনে রাখতে হবে, আমরা এলডিসি থেকে বেরিয়ে তখনই সুবিধা আদায় করতে পারবো যখন আমরা দরকষাকষিতে এগিয়ে থাকবো। এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসার আগে আমাদের হাতে যে সময় রয়েছে, সে সময়ের মধ্যে আমাদের রফতানিপণ্য বহুমুখীকরণ করতে হবে, উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। কারণ আমাদের রফতানি দু-একটি পণ্যের মধ্যে আটকে রয়েছে। এ জন্য বেসরকারি খাতের ব্যর্থতাও রয়েছে। শুধু গার্মেন্ট শিল্পে উৎপাদন রাতারাতি চারগুণ বেড়ে যাবে, আমি সেটি মনে করি না। তাই আমাদের নতুন বাজার খুঁজে বের করার পাশাপাশি নতুন পণ্য রফতানির জন্য প্রস্তুত করতে হবে। কৃষি খাতেও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, এমনকি চীনও বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলেছে। তাই আমাদের মানসম্পন্ন শিক্ষার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, শিক্ষার ক্ষেত্রে সংখ্যাগত দিকের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত মানসম্পন্ন শিক্ষার বিষয়ে।

ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তিনটি বড় সূচকের মধ্যে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে দুটিতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচকে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও সক্ষমতা অর্জনের পথে রয়েছে বাংলাদেশ। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, মালদ্বীপ, ভানুয়াতুর মতো দেশ সক্ষমতা অর্জন করলেও তারা এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসতে চায় না। বাংলাদেশও এলডিসি থেকে বেরিয়ে এলে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। কিন্তু আমাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে। বিশেষ করে এলডিসির বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের সুবিধা পেতে হলে দরকষাকষি করার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ভারত এলডিসি থেকে বেরিয়ে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য বাড়িয়েছে।

তবে যে দেশের জনসংখ্যা বেশি, জমির সংকট রয়েছে, তাদের অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে এগোনো অনেক কঠিন। অবশ্য এর সুবিধাও রয়েছে। নিজেদের দেশেরই বড় বাজার রয়েছে। সে সঙ্গে সস্তা শ্রমের ভিত্তিতে রফতানি বহুমুখীকরণের সুযোগ রয়েছে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, আমাদের পণ্য ও রফতানির বাজার বহুমুখীকরণের প্রতি জোর দিতে হবে। নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। সে সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিজ্ঞানের প্রসার বাড়াতে হবে, উদ্ভাবনী মেধাস্বত্ব অধিকারের বিষয়েও কাজ করতে হবে।

ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০১৮ সালে জাতিসংঘ কমিটিতে যে পর্যালোচনা হবে, তাতে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী অবস্থান থেকে সেখানে যেতে পারবে। তিনি বলেন, হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০২৪ সালে একটা শক্তিশালী অবস্থান থেকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। তবে এর মধ্যে অনেক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বাংলাদেশ যে বাজার সুবিধা পায়, সেগুলো ২০২৭ সালের আর থাকবে না। যেসব বৈদেশিক সহায়তা পায়, সেগুলোর শর্তও কঠিন হতে থাকবে।

এ জন্য আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বাজার এবং রফতানিপণ্যের বৈচিত্র্যকরণ করতে হবে। বৈদেশিক সাহায্যে সুদহার বেড়ে যাবে। তাই এখন থেকেই বৈদেশিক সহায়তার ব্যবহার আরও দক্ষতার সঙ্গে করতে হবে। আমাদের বর্তমান অর্থনীতির কাঠামোকে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন করে একটি উন্নততর কাঠামোতে যেতে হবে। সব মিলিয়ে ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ এমন একটা অবস্থায় থাকব, যেখানে একই সঙ্গে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়াসহ এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাবে। এটা বাংলাদেশের জন্য গৌরবের বিষয়। কিন্তু এজন্য একটা মসৃণ কৌশল নিতে হবে। যেখানে সরকার, ব্যক্তি খাত ও সুশীল সমাজ সবারই একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০