Print Date & Time : 26 June 2025 Thursday 4:33 pm

সিভিল এভিয়েশনের ৩৭৫ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি

রহমত রহমান: বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, নভোএয়ার, রিজেন্ট ও ইউনাইটেড এয়ারওয়েজসহ বিভিন্ন সংস্থার সেবা প্রদান ও সেবা কার্যক্রম থেকে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আদায় করে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি বা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। কিন্তু সংস্থাগুলো সঠিকভাবে সরকারি কোষাগারে মূসক জমা দেয় না বলে অভিযোগ উঠেছে। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মাত্র চার বছরে পৃথকভাবে প্রায় ৩৭৫ কোটি টাকার মূসক ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটির কাছে রাজস্ব আদায়ে পৃথকভাবে দাবিনামা জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। প্রতিষ্ঠানটি বকেয়া আদায়ে গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বকেয়া আদায়ে এনবিআরের নির্দেশনা চেয়েছে সংশ্লিষ্ট ভ্যাট কমিশনারেট। নির্দেশনা পেলে ব্যবস্থা নেবে ভ্যাট কমিশনারেট। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, নভোএয়ার, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ও ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ থেকে বেবিচক অবতরণ ও এম্বারকেশন চার্জ আদায় করে। মূসক আইন অনুযায়ী এ চার্জের ওপর ১৫ শতাংশ মূসক প্রযোজ্য। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেবিচকের বিভিন্ন সেবার ওপর উৎসে মূসক রয়েছে। বেবিচক বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে গ্রহণ করা কনসালটেন্সি, প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ভাড়ার ওপর উৎসে মূসক প্রযোজ্য। এছাড়া বিমানবন্দরের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য দর্শনার্থীদের কাছ থেকে যে প্রবেশমূল্য গ্রহণ করে তার ওপর মূসক প্রযোজ্য। এছাড়া বিভিন্ন সেবা গ্রহণ খাত থেকে মূসক কর্তন করলেও তা পরিশোধ করে না। প্রতিষ্ঠানটি এসব সেবা কার্যক্রমের ওপর মূসক আদায় করলেও বছরের পর বছর তা পরিশোধ করে না বলে অভিযোগ ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভ্যাট উত্তর কমিশনারেট নিরীক্ষা করে।
সূত্র আরও জানায়, বেবিচক এনবিআরের আওতাধীন কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা (উত্তর) কমিশনারেটের ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি সঠিকভাবে মূসক পরিশোধ করে না এবং ভ্যাট অফিসকে কোনোভাবেই সহায়তা করছে না বলে অভিযোগ ওঠে। বেবিচকের বকেয়া রাজস্ব আদায় ও ফাঁকি রোধে গত ২৭ মার্চ এনবিআরের রাজস্ব পর্যালোচনা সভা ভ্যাট উত্তর কমিশনারেট এনবিআরের সহায়তা চায়।
সভায় বেবিচকের বকেয়া রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের সহায়তা চেয়ে চিঠি দিতে বলা হয়। সে অনুযায়ী, বেবিচকের বকেয়া রাজস্ব আদায়ে নির্দেশনা ও সহায়তা চলতি বছরের ১০ এপ্রিল চেয়ে ঢাকা উত্তর কমিশনার জাকিয়া সুলতানা এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয়। এতে বলা হয়, বেবিচক এয়ারলাইনসসহ বিভিন্ন সংস্থাকে দেওয়া সেবা ও সেবা কার্যক্রমের ওপর ২০০৯-১০ ও ২০১১-১২ অর্থবছর পর্যন্ত চার বছরে প্রায় ১৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা ফাঁকি দিয়েছে। বকেয়া আদায়ে প্রাথমিক দাবিনামা জারির পরও প্রতিষ্ঠানটি মূসক পরিশোধ করেনি। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি কোনো সহযোগিতা করতে রাজি নয়। পরে চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করা হয়।
আরও বলা হয়, বেবিচক বিভিন্ন এয়ারলাইনসের কাছে মূসক দাবি করলে ২০১৫ সালে একাধিক এয়ারলাইনস আদালতে রিট করে। আদালত ২০১৬ সালের ১ মার্চ সরকারের পক্ষে রায় দেন। রায়ের আদেশের বিরুদ্ধে এয়ারলাইনসগুলো আপিল দায়ের করে। আপিল বিভাগ ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর সরকারের পক্ষে রায় বহাল রাখে। এয়ারলাইনসগুলো রিভিউ পিটিশন দায়ের করে। রিভিউ পিটিশন মামলাটি ফাইল করার পরেও মামলার শুনানির কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি এবং মামলাটি আপিল বিভাগের কর্জলিস্টেও নেই। ফলে সরকারি বকেয়া মূসক আদায়ে উচ্চ আদালতের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। সম্প্রতি বেবিচক-এর মাধ্যমে সব এয়ারলাইনসকে প্রযোজ্য ?মূসক আদায়ের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অপর চিঠিতে প্রায় ২২০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বকেয়া আদায়ের বিষয়ে বলা হয়, বেবিচক-এর বিভিন্ন সেবার ওপর মূসক প্রযোজ্য। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি কোনো মূসক পরিশোধ করেনি। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিমানের বিভিন্ন সেবার ওপর উৎসে মূসক রয়েছে। এ নিয়ে বেবিচক কর্তৃপক্ষকে উৎসে মূসক পরিশোধে কয়েকবার চিঠি দেওয়া হয়। পরে মূসক ফাঁকি খতিয়ে দেখতে তদন্ত দল গঠন করা হয়। তদন্ত দল বেবিচক কার্যালয় পরিদর্শন ও ২০০৯-১০, ২০১০-১১ ও ২০১১-১২ অর্থবছরের বার্ষিক রিপোর্ট পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে বিমানের বিপুল পরিমাণ উৎসে মূসক ফাঁকিসহ নানা অনিয়ম তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, মূসক ফাঁকির তদন্ত প্রতিবেদন বেবিচক কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হলেও তারা কোনো জবাব দেয়নি। পরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, নভোএয়ার, রিজেন্ট ও ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ বেবিচক কর্তৃপক্ষকে অবতরণ এম্বারকেশন চার্জ হিসেবে কী পরিমাণ চার্জ দিয়েছে, তার তথ্য নেওয়ার জন্য একটি তদন্ত দল গঠন করা হয়। তদন্ত দল ২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন দাখিল করে।
এতে দেখা যায়, অবতরণ চার্জ ও এম্বারকেশন চার্জের ওপর ১৫ শতাংশ হারে উৎসে মূসক প্রযোজ্য। সে হিসেবে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, নভোএয়ার, রিজেন্ট ও ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে প্রায় ১১১ কোটি টাকার চার্জের ওপর কোনো মূসক প্রদান না করে প্রায় ১৯ কোটি টাকা ফাঁকি দিয়েছে। যার মধ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস বিমান কর্তৃপক্ষকে অবতরণ ও এম্বারকেশন চার্জ হিসেবে ১০৬ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে, যার ওপর ১৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য মূসক প্রায় ১৬ কোটি টাকা। নভোএয়ার ৫৬ লাখ টাকা চার্জের ওপর মূসক আট লাখ টাকা, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ প্রায় দুই কোটি টাকা চার্জের ওপর মূসক ২৫ লাখ টাকা ও ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের প্রায় আড়াই কোটি টাকার চার্জের ওপর আড়াই কোটি টাকার মূসক প্রযোজ্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বেবিচক কর্তৃপক্ষ চারটি এয়ারলাইনস কোম্পানি হতে যে পরিমাণ চার্জ আদায়ের কথা বলেছে, বার্ষিক রিপোর্ট পর্যালোচনা করে অনেক বেশি চার্জ আদায়ের তথ্য পাওয়া গেছে। এতে বোঝা যায়, বেবিচক কর্তৃপক্ষ এ চারটি এয়ারলাইনস ছাড়া আরও অনেক কোম্পানি থেকে চার্জ আদায় করেছে। প্রতিবেদনে বার্ষিক রিপোর্ট পর্যালোচনা করে ২০০৯-১০, ২০১০-১১ ও ২০১১-১২ অর্থবছরের খাতভিত্তিক প্রায় ২২১ কোটি টাকার মূসক ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়। এর মধ্যে নিলাম পণ্য, ইজারাদার, কার্গো পণ্য, এম্বারকেশন ফিসহ বেশ কিছু খাত রয়েছে।
বেবিচক কর্তৃপক্ষ সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে মূসক অব্যাহতিপ্রাপ্ত বললেও এনবিআর বলছে বিমান কর্তৃপক্ষ উৎসে কর্তনকারী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি পণ্য বা সেবা সরবরাহ করে বিধান অব্যাহতির সুযোগ নেই। বেবিচক কর্তৃপক্ষ এনবিআর চেয়ারম্যানকে মূসক প্রত্যাহার চেয়ে চিঠি দেয়। কিন্তু এনবিআর বলে বিমান কর্তৃপক্ষ এর কাছে ল্যান্ডিং চার্জ এম্বারকেশন ফি ও বোর্ডিং চার্জের ওপর ১৫ শতাংশ উৎসে মূসক আরোপের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পরে ভ্যাট কমিশনারেট মূসক আইন অনুযায়ী প্রায় ২২০ কোটি ৯৬ লাখ টাকার মূসক পরিশোধে দাবিনামা ও কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে। এছাড়া আরও ফাঁকি উদ্ঘাটনে চেষ্টা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাইম হাসান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ভ্যাট বিষয়ে এখনও সুরাহা হয়নি, বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আমরা এ নিয়ে এনবিআরের সঙ্গে মিটিং করেছি। আমরা ভ্যাট ভোগ করি না, শুধু কালেক্ট করি। কালেক্ট করে কোষাগারে জমা দিই, ফাঁকি হবে কেন?’