প্রতিনিধি, সিলেট: ভারত থেকে নেমে আসা উজানের ঢল ও টানা বৃষ্টিতে সিলেটে বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। সীমান্তবর্তী ছয় উপজেলাসহ সব কয়টি উপজেলায় পানিবন্দি পৌনে সাত লাখ মানুষ। এদিকে সিলেটের ১১ হাজার ৭০৭ হেক্টর জমির ফসল প্লাবিত হয়েছে।
এদিকে টানা বৃষ্টির ফলে সুরমা নদীর পানি ছড়া ও নালা উপচে প্রবেশ করেছে মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায়। তৈরি হয়েছে জলাবদ্ধতা। ঘর থেকে বাইরে বের হতে গিয়ে পড়তে হচ্ছে নানা সমস্যায়। সিলেট মহানগরীতে ৫০ হাজার মানুষ রয়েছেন পানিবন্দি অবস্থায়। এ ছাড়া সিলেটের ১৩টি উপজেলায় পানিবন্দি রয়েছেন ৬ লাখ ২৫ হাজার ৯৩৭ জন। সিলেট জেলা প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যমতে, মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া সুরমার পানি সিলেট পয়েন্টে ২৭ সেন্টিমিটার, অমলসীদ পয়েন্টে কুশিয়ারার পানি ৪৭ সেন্টিমিটার ও একই নদীর ফেঞ্চুগঞ্জে ৮৮ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপরে। আর সারি গোয়াইনের পানি ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সিলেট নগরীর শাহজালাল উপশহর, বরইকান্দি, যতরপুর, মেন্দিবাগ, শিবগঞ্জ, রায়নগর, সোবহানীঘাট, কালিঘাট, কামালগড়, মাছিমপুর, তালতলা, জামতলা, কাজিরবাজার, মাদিনা মার্কেট, আখালিয়া ও মেজরটিলাসহ অধিকাংশ এলাকা বন্যাকবলিত। এছাড়া জেলার গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জসহ কয়েকটি উপজেলার আঞ্চলিক সড়কগুলো বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ার পাশাপাশি অনেক কৃষিজমির ফসল তলিয়ে গেছে, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ।
এদিকে ৬২৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ১৭ হাজার ২৮৫ জন। ১৩টি উপজেলায় ১ হাজার ৩২৩টি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, গোলাপগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর উপজেলা। সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোবারক হোসেন জানান, বন্যাকবলিত উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছে। জেলা ও উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠক হয়েছে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। বন্যাকবলিত মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হচ্ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবার কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হবে।
প্রসঙ্গত, গত ২৭ মে ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল। এতে জেলার অন্তত সাড়ে ৭ লাখ মানুষ আক্রান্ত হন। ৮ জুনের পর থেকে বন্যা পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসে। তবে ঈদের আগের দিন রোববার (১৬ মে) মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া টানা ভারী বৃষ্টিতে আবারও সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়।
এদিকে ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটের ১১ হাজার ৭০৭ হেক্টর জমির ফসল প্লাবিত হয়েছে। তবে কী পরিমাণ ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটা পানি নেমে গেলেই কেবল নির্ধারণ করা সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবারের তথ্য অনুযায়ী, জেলার মাঠে এখনও ফসল আছে ২০ হাজার ৩৮৪ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে প্লাবিত হয়েছে ১১ হাজার ৭০৭ হেক্টরের ফসল। প্লাবিত হওয়া ফসলের মধ্যে ৫ হাজার ৯৮২ হেক্টর আউশ ধান, ৮৫৬ হেক্টর আউশ বীজতলা, ৪ হাজার ৭০৮ হেক্টর গ্রীষ্মকালীন সবজি এবং ১৬১ হেক্টর বোনা আমন। আউশ ধানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে জৈন্তাপুর উপজেলায়। এখানে ২ হাজার ৮৪৫ হেক্টর আউশ ধানের মধ্যে প্লাবিত হয়েছে ১ হাজার ৪৩২ হেক্টর। সিলেট সদর উপজেলায় ১ হাজার ১৩০ হেক্টর আউশ ধানের মধ্যে ১ হাজার ৪৪ হেক্টরই প্লাবিত হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মোহাম্মদ আনিছুজ্জামান বলেন, ‘দুর্যোগকবলিত হয়ে আউশ ও সবজি ফসলের কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটা এখন নির্ধারণ করা কঠিন। পানি নেমে গেলেই এ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হবে।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা যায়, সিলেট জেলার উপজেলাগুলোয় প্লাবিত হওয়া আউশ ধানের মধ্যে বিশ্বনাথে ৮৬১ হেক্টর, গোলাপগঞ্জে ৭৫০, ফেঞ্চুগঞ্জে ৫৬০, গোয়াইনঘাটে ৪১৫, জকিগঞ্জে ৩৫০, ওসমানীনগরে ৩১০, বিয়ানীবাজারে ৯০, কানাইঘাটে ৭৫, দক্ষিণ সুরমায় ৫০, কোম্পানীগঞ্জে ৪০ ও বালাগঞ্জে ৫ হেক্টর রয়েছে। প্লাবিত হওয়া আউশ বীজতলার মধ্যে গোলাপগঞ্জে ১৬০ হেক্টর, বিশ্বনাথে ১৫৪, সিলেট সদরে ১০০, জৈন্তাপুরে ৯৫, দক্ষিণ সুরমায় ৮০, বিয়ানীবাজারে ৫৫, ফেঞ্চুগঞ্জে ৪৮, কানাইঘাটে ৪২, বালাগঞ্জে ৩৫, ওসমানীনগরে ২৯, কোম্পানীগঞ্জে ২৭, জকিগঞ্জে ২৩ ও গোয়াইনঘাটে ৮ হেক্টর রয়েছে। জেলায় মোট ৬ হাজার ৬১৩ হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন সবজি আছে। এর মধ্যে বিশ্বনাথ উপজেলার ১ হাজার ১২০ হেক্টর, সিলেট সদরে ৭২০, বিয়ানীবাজারে ৫৩০, জকিগঞ্জে ৪৬৫, গোলাপগঞ্জে ৪৫০, ফেঞ্চুগঞ্জে ৪৪৮, দক্ষিণ সুরমায় ৪৩৫, বালাগঞ্জে ১৭৫, গোয়াইনঘাটে ১০৫, ওসমানীনগরে ১০০, জৈন্তাপুরে ৮০, কোম্পানীগঞ্জে ৫২ ও কানাইঘাটে ২৮ হেক্টর গ্রীষ্মকালীন সবজি প্লাবিত হয়েছে।
সিলেটের প্লাবিত হওয়া বোনা আমনের মধ্যে গোয়াইনঘাটে ৮২ হেক্টর, কানাইঘাটে ৩৬, জকিগঞ্জে ১৮, দক্ষিণ সুরমায় ১১, জৈন্তাপুরে ১০ ও বালাগঞ্জে ৪ হেক্টর রয়েছে। জেলায় মোট বোনা আমন আছে ১৬৭ হেক্টর জমিতে।
এদিকে সিলেটে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) অনুরোধে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের নির্দেশনায় ইন এইড টু দি সিভিল পাওয়ারের আওতায় সিলেটে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ সুরমা বড়ইকান্দি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র রক্ষায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।
গতকাল বুধবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, এই বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রটি থেকে সিলেট রেলওয়ে স্টেশন, সিলেট শহরের পার্শ্ববর্তী বরইকান্দি, কামালবাজার, মাসুকগঞ্জ, বিসিক, লালাবাজার, শিববাড়ী ও কদমতলীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালসহ সংলগ্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এসব এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকল্পে সেনাসদস্যরা কাজ করে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় ইন এইড টু দি সিভিল পাওয়ারের আওতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিয়ে আসছে।