নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের সর্ববৃহৎ গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। সারাদেশে সরবরাহকৃত গ্যাসের ৫৭ শতাংশই এ কোম্পানিটি বিতরণ করে। তবে কোম্পানিটির কেনা গ্যাসের সঠিক হিসাব নেই। কারণ তিতাসের সিস্টেম লস নিয়ে রয়েছে বড় ধরনের গোঁজামিল। কোম্পানিটির নিরীক্ষিত বার্ষিক প্রতিবেদনে এ-সংক্রান্ত সঠিক তথ্য দেয়া হয়নি। এমনকি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির জন্য জমা দেয়া আবেদনেও সঠিক তথ্য দেয়নি কোম্পানিটি।
এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানিটির ৭৫ শতাংশ শেয়ারই রয়েছে পেট্রোবাংলার কাছে। ফলে বছরশেষে ঘোষণা করা লভ্যাংশের তিন-চতুর্থাংশই নিয়ে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা। আর উৎসে করের নামে আয়ের বড় একটি অংশ কেটে রাখছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে বড় ধরনের ক্যাশ ফ্লো সংকটে রয়েছে তিতাস। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির শুনানিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গতকাল বিয়াম ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত গণশুনানির তৃতীয় দিনে তিতাসের প্রস্তাবের ওপর আলোচনা হয়। এতে কোম্পানিটির গত দুই অর্থবছরের প্রকৃত আর্থিক চিত্র এবং চলতি অর্থবছরের সম্ভাব্য অবস্থা তুলে ধরা হয়। এ সময় দেখানো হয় গত দুই অর্থবছর তিতাসের হিসাবে সিস্টেস লস ছিল দুই শতাংশ। তবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি কমিটি দেখায় ওই দুই বছর তিতাসের সিস্টেম লস ছিল ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ।
শুনানিতে তিতাস জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছর তাদের গ্যাস কেনার পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৪১৬ দশমিক ৫০ এমএমসিএম (মিলিয়ন কিউবিক মিটার)। ওই অর্থবছর তাদের গ্যাস বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ১০৮ এমএমসিএম। অর্থাৎ ওই অর্থবছর তিতাসের সিস্টেম লস দুই শতাংশ বা ৩০৮ দশমিক ৫০ এমএমসিএম গ্যাস। আর পরের (২০২০-২১) অর্থবছর তিতাসের গ্যাস কেনার পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ১৮৪ এমএমসিএম। আর ওই অর্থবছর তাদের গ্যাস বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৮৫৮ এমএমসিএম। এতে ওই অর্থবছর তিতাসের সিস্টেম লস দাঁড়ায় দুই শতাংশ বা ৩২৬ এমএসসিএম গ্যাস।
যদিও বিইআরসির কারিগরি কমিটি দেখায়, ২০১৯-২০ অর্থবছর তিতাসের গ্যাস কেনার পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৫৫৬ দশমিক ৬৯ এমএমসিএম আর বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ১০৮ এমএমসিএম। অর্থাৎ ওই অর্থবছর গ্যাস অপচয় হয় দুই হাজার ৪৪৮ দশমিক ৬৯ এমএমসিএম। ফলে তিতাসের সিস্টেম লস দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছর তিতাসের গ্যাস কেনার পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ২১৮ দশমিক ৮১ এমএমসিএম। ওই অর্থবছর তাদের গ্যাস বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৮৫৮ এমএমসিএম। এতে ওই অর্থবছর গ্যাস অপচয় হয় দুই হাজার ৩৬০ দশমিক ৮১ এমএমসিএম। ফলে তিতাসের সিস্টেম লস দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
যদিও এ হিসাবকে অস্বীকার করে তিতাস জানায়, তাদের সিস্টেম লস অনেক কম। আর তা বিইআরসির নির্ধারিত হার দুই শতাংশই আছে। তাদের গ্যাস কেনার পরিমাণ এত বেশি নয়। তবে শুনানিতে তিতাসের বক্তব্য সঠিক নয় বলে দাবি করে বিইআরসির কারিগরি কমিটি। তারা জানায়, তিতাসের গ্যাস কেনার হিসাব সঠিক নয়। বরং গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) তিতাসকে কতটা গ্যাস দিচ্ছে তার ভিত্তিতেই এ হিসাব করা হয়েছে। তাই সিস্টেম লসের সঠিক হিসাব দেয়নি কোম্পানিটি।
এদিকে গণশুনানিতে গ্যাস বিতরণ মার্জিন বাড়িয়ে ৬৮ পয়সা করার দাবি জানায় তিতাস। এর কারণ ব্যাখ্যায় তিতাস জানায়, ২০১৫ সালে তিতাসের বিতরণ মার্জিন ছিল ৫৫ পয়সা। সে সময় এনবিআর এর ওপর তিন শতাংশ হারে উৎসে কর আরোপ করে। পরবর্তীতে বিইআরসি বিতরণ মার্জিন কমিয়ে ২৩ পয়সা করে, বর্তমানে তা ২৬ পয়সা। তবে এনবিআর ৫৫ পয়সাকেই বিতরণ মার্জিন ধরে রেখে উৎসে কর কেটে যাচ্ছে। এতে বড় ধরনের রাজস্ব ঘাটতির মুখে পড়েছে কোম্পানিটি।
গত পাঁচ বছরের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে তিতাস জানায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছর তিতাসের কর-পূর্ববর্তী মুনাফা ছিল ৯৭০ কোটি দুই লাখ টাকা। সে সময় কোম্পানিটির কর দায় দাঁড়ায় ২৪০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। তবে এনবিআর ওই অর্থবছর কেটে নিয়েছে ৩৩৮ কোটি ১০ লাখ টাকা। এভাবে প্রতি বছর অধিক হারে কর কেটে নিচ্ছে এনবিআর, যা পরবর্তীতে সমন্বয়ও করে না সংস্থাটি। এতে ২০১৫-১৬ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর (পাঁচ বছরে) এনবিআর অতিরিক্ত এক হাজার ৩০৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা কেটে নিয়ে গেছে।
এদিকে তিতাসের ২৫ শতাংশ শেয়ার পুঁজিবাজারে ছাড়া হয়েছে। আর বাকি ৭৫ শতাংশ রয়েছে পেট্রোবাংলার কাছে। তাই প্রতি বছর ঘোষিত লভ্যাংশ নিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছর তিতাসের কর-পরবর্তী মুনাফার পরিমাণ ছিল ৭০৪ কোটি ২১ লাখ টাকা। ওই সময় কোম্পানিটি ৩৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এতে গত অর্থবছর লভ্যাংশ হিসেবে ২৫৬ কোটি টাকা বণ্টন করেছে। এর মধ্যে ১৯২ কোটি টাকা গেছে পেট্রোবাংলার কাছে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পেয়েছে ৬৪ কোটি টাকা।
এদিকে তিতাসের বৈধ গ্রাহক রয়েছে ২৮ লাখ ৭৫ হাজার ৮১৩। তবে সংস্থাটির অবৈধ গ্রাহক কয়েক লাখ হবে বলে শুনানিতে জানানো হয়। তবে এর প্রকৃত সংখ্যা জানাতে পারেনি কোম্পানিটি। তাই অবৈধ গ্রাহক শনাক্ত ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তা নেয়া এবং এ বিষয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রদানের প্রস্তাব করেন কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম।
এর বাইরে তিতাসের বকেয়া নিয়েও শুনানিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এ সময় জানানো হয়, তিতাসের বকেয়া বিলের পরিমাণ ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থার কাছে আটকে আছে প্রায় ৭৪৩ কোটি টাকা। আর বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া প্রায় তিন হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এ বকেয়া আদায়ে বিইআরসি ও ক্যাবের সহায়তা নেয়ার প্রস্তাবও দেয়া হয়।