সীমান্ত হত্যা: বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বে এক বিপত্তিকর উচ্চারণ

 

খন্দকার আপন হোসাইন : পৃথিবীজুড়ে আলোচিত সীমান্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত, উত্তর কোরিয়া-দক্ষিণ কোরিয়া সীমান্ত, প্যালেস্টাইন-ইসরায়েল সীমান্ত, ইরান-ইরাক সীমান্ত, আজারবাইজান-আর্মেনিয়া সীমান্ত, সিরিয়া-ইসরায়েল সীমান্ত এবং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। নীতিমালা অনুযায়ী সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। সীমান্তপাড়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই নীতিমালা জানেও না, বোঝেও না। জš§লগ্ন থেকে সীমান্তে বেড়ে ওঠা শিশু, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধের কাছে সমতল মাটির বুকে কাঁটাতারের বেড়া কখনোই দেশ বিভাজনের প্রতীক হয়ে ওঠে না। সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত দরিদ্র নাগরিকদের বিভিন্ন কারণে সীমান্ত অতিক্রম করার প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে জরুরি চিকিৎসাসেবা ও প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ের প্রয়োজনে সীমান্ত পাড়ি দেয়া সীমান্তবর্তী জনগণের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

স্যার সিরিল র?্যাডক্লিফের সীমা নির্ধারণ লাইনের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ-ভারত সীমারেখা ৪১৫৬.৫৬ কিলোমিটার। আন্তর্জাতিক বিবেচনায় এটি বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম ভূমি সীমানা। কাঁটাতারের বেড়ার মাধ্যমে দেশ দুটির সীমানা সংরক্ষিত হয়। সীমান্ত প্রহরায় অতন্দ্র ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশের পক্ষে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং ভারতের পক্ষে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা ও বিচারবিহীন একপাক্ষিক কার্যক্রম বন্ধুত্বের মধুর সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। বর্তমান বিশ্বে সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্তগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত একটি। কিছুদিন পরপরই বাংলাদেশ গণমাধ্যমের প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠে সীমান্ত হত্যাকাণ্ড। গত ২৬ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে আবুল কালাম ডাকুর নির্মম হত্যাকাণ্ড সীমান্ত হত্যার বিষয়টি আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও  শালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রথম পাঁচ মাসে বিএসএফের গুলিতে ১৭ জন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ড একটি সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে নিরীহ বাংলাদেশিদের। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারিতে বিএসএফের গুলিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছিল কিশোরী ফেলানী খাতুন। তার মরদেহ সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে ছিল। তখন কুড়িগ্রামের কিশোরী ফেলানীর ঝুলন্ত মরদেহের ছবি দেশে-বিদেশে আলোড়ন তুলেছিল। ওই ঘটনার পর সীমান্তে হত্যা বন্ধে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিএসএফ। তবে গত ১৩ বছরের পরিসংখ্যানে সেই প্রতিশ্রুতির চিহ্নমাত্র নেই। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে ১৯৭২ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে নিহতের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার।

সীমান্তসংলগ্ন গ্রামের অধিবাসীদের থেকে জানা যায়, সীমান্ত এলাকায় কয়েকটি প্রভাবশালী সক্রিয় চোরাকারবারিচক্র রয়েছে। যারা বিএসএফের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিংবা গোপনে বিএসএফের সঙ্গে আঁতাত করে অবৈধভাবে ভারতে আসা-যাওয়া করে। উদ্দেশ্য একটাই ভারত থেকে স্বল্পমূল্যে বাংলাদেশে গরু এনে বেশি দামে বিক্রি করা। এটি প্রমাণিত সত্য যে, বিএসএফ সদস্যদের যোগসাজশেই বাংলাদেশে গরু আনা হয়। ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠন ‘মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম)-এর প্রধান, কিরিটী রায় একটি সাক্ষাৎকারে  সীমান্ত হত্যার কারণ স্পষ্ট করেছে। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বিএসএফ সদস্যরা দুর্নীতিগ্রস্ত। যেখানে একদানা চিনিও বিএসএফের নজর এড়িয়ে যেতে পারে না বাংলাদেশে, সেখানে গরু পাচার একেবারেই অসম্ভব। চোরাচালান ঠেকানোর নামে তখনই তারা গুলি করে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা করে যখন তাদের ভাগবাঁটোয়ারায় কম পড়ে। এ কথা সত্যি যে বিএসএফ ও গরু পাচারচক্রের মধ্যে একটি অবৈধ লেনদেনের সম্পর্ক রয়েছে। তবে মাঝে-মধ্যে যখন সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ থাকে তখন যে কাউকে দেখা মাত্রই গুলি ছোড়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। অনেক সময় মানুষ হত্যা করে মরদেহও নিয়ে যায় তারা। অথচ ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় দালালচক্র। তাদের নিয়ন্ত্রণে সীমান্তে চলে সব অপকর্ম। এই দালালচক্রের ইশারাতেও সীমান্তে হত্যাকাণ্ড ঘটে। কারণ সীমান্তের এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয় না। এমনকি অনেক সময় নিরপরাধ লোকদেরও প্রাণ চলে যায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর গুলিতে। অপহরণের ঘটনাও ঘটে। অধিকাংশক্ষেত্রেই হতদরিদ্র পরিবারের সাধারণ নিরীহ সন্তানরাই সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। চোরাকারবারিরাও মাঝে মধ্যে খুন হয়, তবে চোরাকারবারির প্রকৃত কর্তাব্যক্তিরা কীভাবে যেন পার পেয়ে যায়। সীমান্ত হত্যাকাণ্ড কারোরই কাম্য নয়। ভুক্তভোগী সবারই ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু সেই অধিকার কেবল কাগজে কলমেই। বাস্তবে এর যথাযথ প্রয়োগ দেখা যায় না।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অবৈধ কার্যক্রম নিষিদ্ধ যেমন মাদক চোরাচালান, যৌন কাজের জন্য মানব পাচার, জাল মুদ্রা ও বিস্ফোরক পরিবহন। এসব অবৈধ কার্যক্রম কারোরই কাম্য নয়। কিন্তু ভারতীয় বাহিনী কোনো প্রমাণ বা পর্যবেক্ষণ ছাড়াই সীমান্তে মানুষ হত্যা করছে নির্বিচারে। এখানে প্রতিদিনই অনেক মানুষের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাতায়াত, কাজের সন্ধান, পণ্য বিকিকিনি করার জন্য সীমান্ত পার হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। সীমান্তের শূন্যরেখার নিকটস্থ কৃষিজমিতে কৃষিকাজ বা নদীতে মাছ ধরার জন্যও অনেক মানুষকে সীমান্ত পেরোতে হয়। তারা কোনো অপরাধী নয়। নয় কোনো চোরাকারবারি। তবুও এসব সাধারণ জনগণ সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। সীমান্তবর্তী জমিতে চাষাবাদ করার সময়ও অনেক কৃষককে প্রাণ দিতে হয়েছে বিএসএফের গুলিতে। এমনকি বিজবি সদস্য হত্যার অভিযোগেও অভিযুক্ত বিএসএফ। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের ‘শুট অন সাইট’ বা ‘দেখামাত্র গুলি’-এর ক্ষমতা চর্চা বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের সম্পর্কের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। একটি চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হচ্ছে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলন। প্রতিটি সম্মেলনে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা নিয়ে আলোচনা হলেও এর কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।

যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তারা চোরাকারবারি কিংবা সশস্ত্র আক্রমণকারী এমন কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ বিএসএফ দিতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে চোরাকারবারিচক্রের সদস্য সীমান্তের এপার ওপার উভয় স্থানেই রয়েছে। কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রে নিরস্ত্র বাংলাদেশিরাই শুধু নিহত হয়। পার পেয়ে যায় ওপারের সন্ত্রাসীরা। দুই দেশের সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী অননুমোদনহীন সীমান্ত অতিক্রম অনুপ্রবেশ হিসেবে বিবেচিত। অনুপ্রবেশকারীকে গ্রেপ্তার করে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু বিএসএফের একপাক্ষিক আক্রমণ পুরোপুরি নিয়মবিরুদ্ধ।

গত দুই দশক ধরে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। বিষয়টি নিয়ে উভয় সরকারের মাথাব্যথা না থাকলেও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারত সম্পর্কে বিরূপ ধারণা ক্রমেই বাড়ছে। সীমান্তে চোরাচালান ও বাংলাদেশ থেকে কথিত অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিতর্কিত ‘শুট অন সাইট’ নীতি দীর্ঘ দিন থেকেই অনুসরণ করে আসছে। ফলে বিএসএফকে কারণে-অকারণে বাংলাদেশি নাগরিকদের গুলি করে হত্যা করার অবাধ লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। ভারতের সাধারণ মানুষ সীমান্তে ‘শুট অন সাইট’ নীতি সমর্থন করে না। ভারতের ১৮টি মানবাধিকার সংগঠন সীমান্ত হত্যা বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে অনেকদিন ধরে। মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের কয়েকজন সংগঠক বলেছেন বিএসএফের কাজ সীমান্ত পাহারা দেয়া। সীমান্তের ভেতরে ঢুকে নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করা নয়। বিএসএফ সীমান্তে হত্যালীলা বন্ধ না করলে পশ্চিমবঙ্গে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ-ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে  বার বার সীমান্ত হত্যা বন্ধের আশ্বাস দেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

সীমান্ত হত্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যে সর্বাগ্রে সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষকে আইনকানুন সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। সেই সঙ্গে তারা যাতে আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত না থাকে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষের বেকারত্ব নিরসনে উপযুক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। ফলে তারা আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবে না। চোরাচালান করবে না। মাদক কেনাবেচা বন্ধ করবে। সেই সঙ্গে প্রান্তিক জনগণের সীমান্ত পার হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই কমবে। এদের কর্মসংস্থানের জন্য দেশি ও বিদেশি এনজিওগুলোর কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে। সীমান্ত হত্যাকাণ্ড শূন্যে নামাতে কূটনীতিক পদক্ষেপ নেয়া অতি জরুরি। চোরাকারবারি বন্ধে দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের একযোগে কাজ করতে হবে। হতদরিদ্র জনগণকে যে চক্র অবৈধ কাজে ব্যবহার করে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। সর্বোপরি সীমান্ত হত্যা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের বন্ধন আরও মজবুত করা উচিত।

শিক্ষক

ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড হাইস্কুল

শহীদ সালাহউদ্দিন সেনানিবাস, ঘাটাইল, টাঙ্গাইল

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০