রোহান রাজিব: আমানত ও ঋণের ক্ষেত্রে যে ভারসাম্যপূর্ণ শৃঙ্খলা থাকা দরকার, তা ভেঙে ফেলছে ১১টি ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে আগ্রাসীভাবে এসব ব্যাংকঋণ বিতরণ করেছে। ফলে অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) সীমা অতিক্রম হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, প্রচলিত ধারার ব্যাংক ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৮৭ টাকা এবং ইসলামি ধারার ব্যাংক ৯২ টাকা ঋণ দিতে পারে। একে ব্যাংকিং পরিভাষায় অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) বা ঋণ-আমানত অনুপাত সীমা বলা হয়।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের জুনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আমানত ও ঋণের মধ্যে যে ভারসাম্য থাকা দরকার, তা ভেঙে ১১টি ব্যাংকঋণ দিয়েছে। গত ৩০ জুন শেষে প্রচলিত ধারার ন্যাশনাল ব্যাংকের এডিআর দাঁড়িয়েছে ৯৯ দশমিক ১২ শতাংশে। আইএফআইসি ব্যাংকের ৯০ দশমিক ২৯ শতাংশ এবং পদ্মা ব্যাংকের ৮৮ দশমিক ২০ শতাংশ। এবি ব্যাংকের ৯২ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং একই ব্যাংকের ইসলামি উইন্ডোর ১০৭ দশমিক ৬১ শতাংশ।
এছাড়া ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সীমার বাইরে বিনিয়োগের তালিকায় থাকা ইউনিয়ন ব্যাংকের এডিআর দাঁড়িয়েছে ১০১ দশমিক ৮৭ শতাংশে। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৯৩ দশমিক ২১ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংকের ৯৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংকের ১০৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। আর প্রিমিয়ার ব্যাংকের ইসলামি উইন্ডোর ১২২ দশমিক ৮২ শতাংশ, পূবালী ব্যাংকের ইসলামি উইন্ডোর ৯৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ইসলামি উইন্ডোর ১২৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, আমানত, প্রভিশন ও মূলধন নিয়ে এডিআর করতে হয়। অনেক ব্যাংকের রিয়েল এডিআর সমস্যা থাকে। ১০০ শতাংশ থাকলেও খারাপ না। ব্যাংকগুলোর ক্যাপিটাল ও প্রভিশন খারাপ হলে এডিআর খারাপ। তবে যেসব ব্যাংক এডিআরের সীমা অতিক্রম করার তালিকায় রয়েছে, সেগুলো এমনিতেই খারাপ। মূলত ব্যাংকগুলোর লিকিউডিটি ম্যানেজমেন্ট ভালো না হওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোর এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংককে নিয়মিত তদারকি করছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ব্যাংকগুলোর এডিআর সীমা লঙ্ঘনের অন্যতম কারণÑঅনিয়ম, দুর্নীতি এবং বেনামি ঋণ। ব্যাংক খাতে সাম্প্রতিক সময়ে বড় অঙ্কের বেনামি ঋণ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এভাবে চলতে থাকলে খাতটি ঝুঁকিতে পড়বে। এছাড়া আমানতের বিপরীতে সীমার বাইরে ঋণ দিলে ঋণশৃঙ্খলা বিঘœ হয়। ফলে ব্যাংকের পাশাপাশি আমানতকারীদেরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন শেষে পুরো ব্যাংক খাতের এডিআর দাঁড়িয়েছে ৭২ দশমিক ৫৭ শতাংশে। এর মধ্যে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ৭৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ আর ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর ৯১ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি আনিস এ খান শেয়ার বিজকে বলেন, এডিআরের সীমা অতিক্রম করে ঋণ বিতরণ করলে আমনতকারীদের আমানত ঝুঁকিতে থাকবে। কারণ ঋণের টাকা আদায় করে আনতে হবে। আর এডিআরের ক্ষেত্রে যেসব নীতিমালা রয়েছে, তা মেনে চলতে হবে। যদি না মেনে চলে তাহলে কমপ্লায়েন্স লঙ্ঘন হবে। ফলে সুশাসনের ঘাটতি দেখা দেবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র সরোয়ার হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, এডিআরের যে সীমা আছে, তা যদি বারবার অতিক্রম করে তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে লিমিট দিয়ে থাকে, যাতে নতুন করে আগ্রাসী ঋণ বিতরণ করতে না পারে।
ব্যাংকসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত আইনে ঋণ বা বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে টানা পাঁচবার এডিআর সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও অনেক ব্যাংক এটি সমন্বয় করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে গতিশীলতা আনা, ব্যাংক খাতের সার্বিক তারল্য পরিস্থিতির উন্নয়নে এডিআর ২ শতাংশ বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও কিছু ব্যাংক সীমা লঙ্ঘন করে আমানতকারীদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, এডিআর সীমা অতিক্রম করলে ব্যাংকের রেগুলেটরি কমপ্লায়েন্স ভঙ্গ হয়। যার জন্য অনেক সময় জরিমানা দিতে হয়। এসব ব্যাংকের ক্ষেত্রে জরিমানার চিত্র দেখা যায় না। কারণ এরা ক্ষমতার প্রভাবের কারণে ছাড় পেয়ে যায়। তবে ভালো ব্যাংক ভঙ্গ করলে সঙ্গে সঙ্গে জরিমানা করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলো নিয়মিত এডিআর সীমা অতিক্রম করতে থাকলে আমানতকারীদের আমানত ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও কঠোর হওয়া উচিত। সবার ক্ষেত্রে একই ধরনের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। যেহেতু ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী লাইসেন্সপ্রাপ্ত, তাই ব্যবসা করতে হলে নিয়ম মেনেই করতে হবে। নিয়ম লঙ্ঘন করলে ব্যবস্থা নিতে হবে।