Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 11:49 pm

সীমা লঙ্ঘন করে ৮৭৯ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ

জয়নাল আবেদিন : নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মাত্র ২০ গ্রাহককে ২০ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্র মালিকানাধীন জনতা ব্যাংক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে, যা দীর্ঘদিন থেকেই আদায় করতে পারছে না জনতা কর্তৃপক্ষ। বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, জনতা ব্যাংকের এসব গ্রাহক দেশের বৃহৎ গ্রুপগুলোর মধ্যে অন্যতম।

ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শীর্ষ ২০ গ্রাহকের মধ্যে ১৪ জনকেই সীমাতিরিক্ত ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক। এই ১৪ প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার সর্বোচ্চ সীমা ছিল ১৩ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা। কিন্তু তাদের ১৪ হাজার ৮০৫ কোটি টাকার ঋণ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ১৪ গ্রাহককে নির্ধারিত সীমার চেয়ে ৮৭৯ কোটি টাকা বেশি ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। হিসাব করে দেখা গেছে, জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৯ শতাংশই পেয়েছে মাত্র ২০ গ্রাহক।

তথ্যমতে, সীমাতিরিক্ত ঋণ নেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর উল্লেখযোগ্য হল রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড, ক্রিসেন্ট লেদার প্রডাক্ট লিমিটেড, রূপালী কম্পোজিট লেদার ওয়্যার লিমিটেড, ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেল লিমিটেড, গ্যালাক্সি সোয়েটার অ্যান্ড ইয়ার্ন ডায়িং লিমিটেড, সিমরান কম্পোজিট লিমিটেড, সুপার্ভ স্পিনিং লিমিটেড, পাওয়ারপ্যাক মুটিয়ারা জামালপুর পাওয়ার প্লান্ট লিমিটেড, সুপার্ভ কম্পোজিট নিট লিমিটেড ও জ্যাকুয়ার্ড নিটেক্স লিমিটেড।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, আলোচিত ১৪ প্রতিষ্ঠানের কাছে বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে দুই হাজার ৬৫ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে মন্দ মানের খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। যেগুলোকে আদায় অযোগ্য বলে চিহ্নিত করে থাকেন ব্যাংকাররা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, জুন পর্যন্ত ব্যাংকটি ৫২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ বা ১৩ হাজার ২২৯ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে, যা দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। আলোচিত ক্রিসেন্ট ও অ্যাননটেক্স গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘসময় ধরে ঋণশৃঙ্খলা পরিপালন না করে ঋণ বিতরণ করায় খেলাপি ঋণে ধুঁকছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো। হাতেগোনা গ্রাহকদের পকেটে বিপুল পরিমাণ ঋণ দিয়ে তা আর আদায় করতে পারছে না। আদায়ে ব্যর্থ হয়ে তাদের নানা সুবিধা দেয়া হয়েছে। এতেও বড় গ্রাহকের পকেট থেকে অর্থ ফেরত আসছে না। খেলাপি ঋণ কমাতে বাধ্য হয়ে হিসাব থেকে বাদ দিতে অবলোপন করা হচ্ছে। অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে আদালতে মামলা করেও তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না।

২০১৯ সালের জুলাই থেকে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ‘ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং (আইসিআরআর)’ অনুসরণের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নীতিমালা অনুযায়ী, প্রথমত একজন গ্রাহককে এক্সিলেন্ট, গুড, মার্জিনাল ও আন-অ্যাকসেপ্টেবল এই চার শ্রেণিতে ভাগ করবে ব্যাংকগুলো। কোনো গ্রাহক এক্সিলেন্ট রেটিং পেলে ব্যাংক তাকে ঋণ দিতে পারবে। গুড রেটিং পেলেও ব্যাংক তাকে ঋণ দিতে পারবে। মার্জিনাল রেটিংধারী গ্রাহককে পুরোনো ঋণ নবায়ন বা নতুন করে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে ব্যাংককে। আনঅ্যাকসেপ্টেবল রেটিংধারীকে কোনো পরিস্থিতিতেই নতুন ঋণ দিতে পারবে না ব্যাংকগুলো, যদি না আগের ঋণ শতভাগ নগদ পরিশোধ হয় অথবা জামানত দিয়ে ঋণটি আচ্ছাদন করা হয়। এই শ্রেণির গ্রাহকের আগের ঋণ সর্বোচ্চ দুবার নবায়ন বা বর্ধিত করা যাবে। নীতিমালায় বলা হয়েছে, রেটিং করার ক্ষেত্রে একটি পার্টি বা গ্রাহকের পরিমাণগত সক্ষমতায় ৬০ শতাংশ নম্বর এবং গুণগত সক্ষমতায় ৪০ শতাংশ নম্বর থাকবে।

এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের আবদুছ ছালাম আজাদের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি। মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠালেও তার জবাব দেননি তিনি।

তবে ব্যাংকটির ঋণ বিভাগের প্রধান মাশফিউল বারি (জিএম) শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা যখন ঋণের সীমা নির্ধারণ করি তখন অনেকটা রক্ষণশীল থাকি। গ্রাহকের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী সম্পূর্ণ ঋণ দিই না। কিন্তু জাহাজিকৃত পণ্য আমদানি করার জন্য কিছুটা সীমা অতিক্রম করলে তাতে ছাড় দেয়া হয়। তখন ঋণের নির্ধারিত সীমা অনেক সময় অতিক্রম করে। আবার আমদানি সম্পন্ন হলে তারা সেটা পরিশোধ করে দেয়।’

নির্ধারিত সীমার বেশি ঋণ দিলে ব্যাংকের ঝুঁকি বাড়ে কিনা সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করলে তো অবশ্যই ঝুঁকি থাকে। কিন্তু যারা দীর্ঘদিন থেকে ব্যাংকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছে, কোনো খেলাপি নেই ও যাদের থেকে ঋণের টাকা আদায় করা যাবে। তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা কনসিডার (বিবেচনা) করা হয়। তবে শুধু ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে নয়, সবগুলো বিভাগই এখন অনেক সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছে।’ উল্লেখ্য, সীমার অতিরিক্ত ঋণ দেয়া এই ১৪ গ্রাহকের মোট ঋণের মধ্যে মন্দ মানের খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা।