সুইয়ের ফোঁড়ে ভাগ্য ফেরাচ্ছেন যশোরের নারীরা

মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর: যশোর পৌরসভার পূর্ববারান্দীপাড়া এলাকার এক কন্যা ও এক পুত্রসন্তানের জননী শান্তা বেগম (৩৫)। স্বামী নাসির উদ্দীন স্বল্প বেতনে একটি দোকানের কর্মচারী হিসেবে কর্মরত আছেন। অর্থকষ্টে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয় তাদের। এ অবস্থায় শান্তা বেগম সাংসারিক কষ্ট থেকে মুক্তির জন্য নতুন পথ খুঁজতে থাকেন। একসময় এলাকার অন্য নারীদের কাছ থেকে শিখে নেন সুই আর সুতার কাজ। জীবন-জীবিকার তাগিদে স্বামী-সন্তানদের কথা চিন্তা করে ইচ্ছাশক্তি আর সুই-সুতার বুননের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এখন স্বাবলম্বী তিনি।

শুধু শান্তা বেগমই নন, সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা আনতে যশোরের নারীরা সুচের ফোঁড়ে ফোঁড়ে নকশিকাঁথার ওপর ফুটিয়ে তুলছেন নানা রঙের ফুল, পাখি, লতা, পাতাসহ বিভিন্ন কারুকাজ। এভাবেই সুই আর সুতার বুননে ভাগ্যের চাকা ঘোরাচ্ছেন যশোরের নারীরা। পরিবার সামলিয়ে অবসরে নকশিকাঁথাসহ বিভিন্ন ধরনের সেলাইয়ের কাজ করে অনেকে মুক্তি পেয়েছেন দারিদ্র্যের হাত থেকে।

পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও সম্ভাবনার নতুন দ্বার উšে§াচন করেছেন তারা। সময়ের হাত ঘুরে বর্তমানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে পরিণত হয়েছে এ কাজ। এ শিল্পকে ঘিরে জেলায় বর্তমানে কাজ করছেন ছোট-বড় দেড় শতাধিক নারী উদ্যোক্তা। তবে করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছেন তারা। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি সরকারি প্রণোদনার দাবিও জানিয়েছেন তারা।

জানা গেছে, হস্তশিল্পের এ কাজে এখন নারীদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরাও। পড়াশোনার পাশাপাশি বাড়তি অর্থ উপার্জন করে পরিবারকে সাহায্য করছেন অনেকেই। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য সুই-সুতার সেলাইয়ের কাজসহ নকশিকাঁথাকে তারা দিয়েছেন বাণিজ্যিক রূপ। জেলার বিভিন্ন এলাকার দরিদ্র, মধ্যবিত্ত এমনকি শিক্ষিত নারীরাও পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন সুই আর সুতার এ কাজকে। নিজেদের গড়ে তুলেছেন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে। কেবল নকশিকাঁথা নয়, উদ্যোমী এসব নারীরা তৈরি করছেন বাহারি রঙ আর নানা ডিজাইনের সালোয়ার-কামিজ, বিছানার চাদর, সোফার কুশন, পাপোশ, ওয়ালম্যাট, পাঞ্জাবি, ব্যাগসহ নানা ধরনের পোশাক।

যশোর শহরের শংকরপুরের শিক্ষার্থী রুবিনা বলেন, ‘করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় প্রতিদিন তিন ঘণ্টা হাতের কাজ করি। থ্রিপিস, পাঞ্জাবি ও শাড়িতে বিভিন্ন রঙের সুতার মাধ্যমে ফুল তৈরি করি। কাজের ওপর ভিত্তি করে আমাদের মজুরি দেয়া হয়। থ্রিপিস, পাঞ্জাবি দুদিন আর শাড়িতে এক সপ্তাহ কাজ করতে হয়। অবসর সময়ে এ কাজ করে আমার যা উপার্জন করি, সেই টাকা দিয়ে আমি আমার পড়ালেখার খরচ ভালোভাবে চালাতে পারি।’

শহরের রায়পাড়ার শিখা খাতুন বলেন, ‘পড়ালেখার পাশাপাশি হাতে সেলাইয়ের কাজ করি। এ কাজ আমি আমার মায়ের কাছ থেকে শিখেছি। যখন সুযোগ পাই তখনই আমি এ কাজ করি। প্রতি মাসে প্রায় দুই হাজার টাকা আয় করতে পারি। এ টাকা দিয়ে ছোট ভাইদের জন্য খাতা-কলম ক্রয় করে দিই। এ কাজ করে আমি খুশি, কারণ পরিবারের অর্থের জোগান দিতে পারছি।’

উদ্যোক্তা ফাতেমা জোহরা বলেন, ‘একটা মেশিন দিয়ে কাজ শুরু করি। প্রথম পর্যায়ে আমি নিজেই এ কাজ করি এবং লাভজনক হওয়ায় প্রসার ঘাটানোর উদ্যোগ নিই। বর্তমানে আমি ৪০০ কর্মচারী নিয়ে কাজ করছি। দেশের বিভিন্ন জেলায় আমার তৈরি করা নানা ডিজাইনের সালোয়ার-কামিজ, বিছানার চাদর, সোফার কুশন, পাপোশ, ওয়ালম্যাট, পাঞ্জাবি সরবরাহ করি।’

যশোরের পারভিন আক্তার ২০ বছর ধরে এ কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন। শুরুতে দু-চার পিস করে তৈরি করতেন। তবে এখন হাজার হাজার পিস তৈরি করতে হয় তাকে, বিক্রিও ভালো। তবে করোনায় সবকিছু থমকে গেছে বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত নারী উদ্যোক্তা তনুজা রহমান মায়া বলেন, ‘করোনার প্রভাব চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, এ শিল্পকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি সরকারি প্রণোদনা প্রয়োজন। সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ দিচ্ছে সে প্যাকেজটি এক বছর মেয়াদি না করে, যদি তিন বছর মেয়াদি করে তাহলে হয়তো খুব সহজেই হস্তশিল্প ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০